শিরোনাম
◈ এপ্রিলে  ১০১ কোটি ৩৮ লাখ টাকার চোরাচালান পণ্যসামগ্রী জব্দ করেছে বিজিবি ◈ ঐক্যবদ্ধ শাহবাগ বিএনপির অপেক্ষায়: সারজিস আলম ◈ জনআকাঙ্খা ও রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের বিষয়ে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জনতা পার্টি বাংলাদেশের ◈ ভারত-পাকিস্তান তৃতীয় দিনের মতো সংঘর্ষে জড়ালো, যুদ্ধাবস্থা সীমান্তজুড়ে ◈ 'আপ বাংলাদেশ' নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ◈ দেশে অনলাইন জুয়া সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে: অনলাইনে জুয়া বন্ধে কঠোর হচ্ছে সরকার ◈ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে শাহবাগ অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ (ভিডিও) ◈ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে শাহবাগ মোড় অবরোধের ডাক হাসনাতের (ভিডিও) ◈ নারায়ণগঞ্জ থেকে কাশিমপুর কারাগারে আইভী ◈ ‘মিথ্যাচার ও আক্রমণাত্মক বক্তব্যের’ জবাব দিলেন আসিফ নজরুল

প্রকাশিত : ১১ জুন, ২০২৩, ০২:০৯ রাত
আপডেট : ১১ জুন, ২০২৩, ০২:০৯ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

১৫ বছরের উন্নয়নের অর্জন ১৫ মাসেই ধ্বংস হতে পারে!

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী 

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: বাংলাদেশ গত ১৫ বছরে আর্থসামাজিক খাতে এমন বেশ কিছু অর্জন সাধন করতে পেরেছে, যা নিকট অতীতে আমরা কেন পৃথিবীর অনেক দেশ এবং সরকার, এমনকি অর্থনীতিবিদরাও ভাবতে পারেননি। এর একটি কারণ ছিল মূলত ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ চলা কালে আমাদের অর্থনীতি প্রায় সম্পূর্ণটাই পাকিস্তানিরা ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছিল। এর আগে ২৩ বছর পাকিস্তান রাষ্ট্র আমাদের এই অঞ্চলের অর্থকরী, প্রধান ফসল, সোনালী আঁশ পাট থেকে যা কিছু বিদেশে রপ্তানি করে অর্জন করেছিল তার সিকিভাগও আমরা এই অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য পাইনি। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী করাচি, রাওয়ালপিন্ডি এবং ইসলামাবাদে যে তিনটি রাজধানী স্থাপন করেছিল তা পূর্ব বাংলার পাট থেকে অর্জিত অর্থ থেকেই করিয়েছিল। বাংলাদেশ ভূখণ্ড সবসময়ই ছিলো অর্থনীতির সম্ভাবনাময় পলিমাটির দেশ। মুঘল আমলে সে কারণে বাংলার নাম ছিল স্বর্গরাজ্য। 

অ্যাডাম স্মিথও সে কারণে পলিবাহিত ব-দ্বীপকে সম্পদ ও সম্বৃদ্ধির অঞ্চল হিসাবে অভিহিত করেছিলেন। সেই বাংলা পাকিস্তানিরা ২৩ বছর শোষণের মাধ্যমে ফাঁকা করে ছিলো, একাত্তরে যখন বুঝতে পেরেছিল যে তাঁরা থাকতে পারবে না তখন এই অঞ্চলের ৩০ লক্ষ মানুষকে যেমন মেরেছে, রাস্তা-ঘাট, পুল-কালভার্ট, শিল্প-কারখানা, নদীবন্দর-সমুদ্রবন্দর সবই ধ্বংস করে দিয়েছিল। ব্যাংকে গচ্ছিত যত অর্থ ছিল তাও লুটপাট করে নিয়ে গিয়েছিল বা পুড়িয়ে দিয়েছিল। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যাংকে লেনদেন করার মতো একদিনের অর্থও ছিল না। চারদিকে পোড়া বাড়ি আর পোড়া মাটি। এক কোটি মানুষ দেশত্যাগী ছিল। ১৬ ডিসেম্বরের পর এরা ফিরে আসতে থাকে, যুদ্ধাহতরা ফিরে আসলেও চিকিৎসার কে নো ওষুধ নেই। এমনই এক শূন্য হাতের যাত্রা যে দেশের, সে দেশকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার লোক দেশে এবং বিদেশে কম ছিল না। ১৯৭২ সালেই তো হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে আখ্যায়িত করলেন। কিন্তু জাতির জনক কারাগার থেকে ফিরে এসে যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশের উপর দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, আমার ঊর্বর মাটি আছে, সোনার মানুষ পয়দা করতে পারলেই আমার দুঃখী মানুষের মুখে দুবেলা অন্ন জোটাতে, পরিধেয় কাপড়, গৃহহীনকে গৃহ দান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যাবস্থা আমি করতে পারবো। এই মাটির সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান ভালো করতে জানতেন বাংলার ইতিহাস। রাজনীতি এবং দেশের মানুষকে সর্বস্ব বিলিয়ে তিনি এমন সত্যনিষ্ঠ কথা উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন। গোটা জাতির জন্য তিনি একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে আথাপিছু আয় মাত্র ৯২ ডলার ছিল, ১৯৭৫ সালের জুন মাসে তা দাঁড়ায় ২৯০ ডলারে। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ তখন জাতিসংঘ কর্তৃক স¦ল্পোন্নত দেশের তালিকায় নাম ওঠাতে সক্ষম হয়। নেতৃত্বের গুণেই এতসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সাড়ে তিন বছরে তার সম্ভাবনার ইঙ্গিত জানান দিয়েছিলো মাত্র।

কিন্তু সেই রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ১৫ আগস্ট থেকে ৩ নভেম্বরে শুধু ক্ষমতাচ্যুতই নয়, নৃশংসভাবে হত্যাও করা হয়েছিল, অনেককে জেলে বন্দী করে রাখা হয়েছিল, দেশটাকে রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্য করা হয়েছিল। ১৯৭৬ সালে এই রাষ্ট্রের মাথাপিছু আয় একশত ডলার কমে গেলো। এভাবে আমাদের অর্থনীতি থমকে গেলো। উপুরিউপুরি বলা হতে থাকলো ধর্মের কথা, গণতন্ত্রের কথা। কিন্তু দেশে বিরাজ করছিলো কারফিউ গণতন্ত্র। আবার শোনানো হলো, খাল কাটার বিপ্লবের কথা। বিপ্লব সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও মানুষের মননে নয়, খাল কাটা কুমির হয়ে আবির্ভূত হলো। এই রহস্য বোঝার চেষ্টা হয়নি। তখন মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের যারা যেতেন তাদের মিসকিন বলে ‘সমাদর’ করা হতো। আমাদের তখন লজ্জাবোধ থাকার কথা নয়; ভিক্ষুকের যেমনটি থাকে না। দেশ দুই দশকেরও বেশি সময় এভাবেই কেটে গেলো। ১৯৯০ সালে আমাদের রিজার্ভ শূন্য হয়ে গেলো। তাহলে আমাদের উন্নয়ন কোথায় গেলো! কোনও বিদেশি তখন বাংলাদেশকে সম্ভাবনার দেশ বলে আর ভাবতে চায়নি। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী প্রতিবছর বাজেট প্রণয়নের আগে একটি ব্রিফকেস নিয়ে প্যারিস কনসোর্টিয়ামে যেতেন। সেখান থেকে প্রতিশ্রুত বিদেশি অর্থ নির্ভর করে বাজেট প্রণয়ন ও ঘোষণা করতেন। ওই বাজেট বাস্তবায়নের ফল বাংলাদেশ খুব কমই ভোগ করতে পারতো। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনশত ডলার অতিক্রম করতে পারেনি। ফলে আমাদের দারিদ্র্য বিমোচনের স্বপ্ন অধরাই থেকে গিয়েছিল। ছোট্ট একটি গোষ্ঠী দুর্নীতি ও অর্থ লোপাটের মাধ্যমে ফুলে ফেপে উঠেছিল। বাংলাদেশকে তখনও বলা হতো বিশ্বের অন্যতম দরিদ্রতম দেশ। সেই দেশটির হাল হকিকত কেন এমনটি হয়েছিল। তার কি সহজ কোনো উত্তর আমরা খোঁজার চেষ্টা করেছি। এর উত্তরটি খুব কঠিন নয়। নির্মম সত্য হলো, আমাদের তখনও দেশকে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারায় নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কোনো সরকারই দেশের ক্ষমতায় ছিল না।

১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর, দেশে কৃষিকে প্রাধান্য দেওয়া হলো, বিদেশ নির্ভরতা কমিয়ে ফেলা হলো। গঙ্গা পানিচুক্তি করা হলো, পার্বত্য শান্তিচুক্তি করা হলো। পলিমাটির এই দেশ আবার সবুজ ফসলে ভরে উঠলো। দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনে এক নীরব বিপ্লব সংগঠিত হয়ে গেলো। শতাব্দীর ভয়াবহতম বন্যায়, ১৯৯৮ সালে বিদেশিরা ধরে নিয়েছিল কোটি মানুষের বেশি দুর্ভিক্ষ পীড়িত হবে। কিন্তু এইসব ভবিষ্যৎবাণী ব্যর্থ প্রমাণিত হলো। তখনই অমর্ত্য সেন ও মাহমুদুল হকের মতো অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথা বিদেশে বলতে থাকলেন। কিন্তু অনেকেই বিশ্বাস করেননি কারণ পরবর্তী বছরগুলোতে যারা ক্ষমতায় ছিলেন তাদের কাছে উন্নয়নের সেই নীতি কৌশল পরিত্যাজ্য হয়েছিল।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনা দিন বদলের সনদ প্রণয়ন করে  বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের যে রুপকল্প নিয়ে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন তা খুব কম দেশি ও বিদেশি বুঝতে পেরেছিলেন। ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশে পরিনত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলেন। তার এই পরিকল্পনাই ছিল খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা, বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে শিল্প ও বাণিজ্য এবং সামাজিক জীবন ব্যবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন নিয়ে আসা, দেশকে ডিজিটালাইজড করা, যোগাযোগ ব্যবস্থার নেটওয়ার্কে বাংলাদেশ যেন শুধু অভ্যন্তরীণ ভাবেই নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও নেটওয়ার্কের মধ্যে অবস্থান করে। শিক্ষা, দারিদ্র্য বিমোচন, চিকিৎসা ও সামাজিক সুরক্ষার খাতকে প্রসারিত করা। শেখ হাসিনা ক্ষুদ্র, মাঝাড়ি ও বৃহৎ প্রকল্পের আওতায় অর্থনীতির সকল খাতকে যুক্ত করে নিলেন। প্রতিবেশী ভারতের সাথে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত অনেকগুলো সমস্যার সমাধান করলেন। সমুদ্রসীমানা নিয়ে বিরোধের এক ঐতিহাসিক সমাধান তিনি নিয়ে আসতে পারলেন। এই সময়ে  গ্রামীণ সমাজ ব্যাবস্থায় এক আমূল পরিবর্তন ঘটে গেলো। গ্রাম এবং শহরের উন্নয়নের এক সংযোগ ঘটে গেলো। গ্রামীণ সমাজে এক বিশাল মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠেছে, ফলে দারিদ্র্যের হার কমতে কমতে এখন ১৮ শতাংশ এবং অতি দারিদ্র্যের হার ৫ শতাংশের ঘরে দাঁড়িয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক নিরাপত্তাবিধান, আশ্রয়হীনদের আশ্রয়ের ব্যাবস্থা করা, লিঙ্গভেদে সকলকেই উন্নয়নের স্রোতধারায় শামিল করা, শিক্ষা ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি, জ্ঞ্যানবিজ্ঞান, গবেষণাকে গুরুত্ব দেওয়া ইত্যাদি কর্মসূচিতে বাংলাদেশকে গত ১৫ বছরে আক্ষরিক অর্থেই উন্নয়নের স্রোতধারায় নিয়ে গিয়েছেন। 

বাংলাদেশ তার সময়ে এসেই স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করার স্বীকৃতি অর্জন করে। এর পরেই আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করি।  এর মধ্যে আমাদের মাথাপিছু আয় ৭৫০ থেকে ২৮২৫ ডলারে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প সারাবিশ্বে বাজার ধরেছে। অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের ইর্ষনীয় উন্নতি ঘটছে। তবে এখনও বেশ কিছু খাতের উন্নয়ন টেকসই পর্যায়ে যায়নি। আরও সময়ের প্রয়োজন রয়েছে স্থিতিশীল মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার জন্য। এর মধ্যে করোনা সঙ্কট, ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক অবরোধ বিশে^ চরম অর্থনৈতিক সঙ্কট নিয়ে আসে। এর অভিঘাত অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও পড়েছে। আফ্রিকার বহু দেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান সেই অভিঘাতে এখন বিপর্যস্ত। অথচ শ্রীলঙ্কা কিংবা পাকিস্তানের অবস্থা এমন পর্যায়ে নেমে যাবে তা কেউ ভাবতেও পারেনি। রাজনৈতিক নেতৃত্বের শূন্যতা এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিভিন্ন গোষ্ঠীর অবিমৃশ্যকারীতা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টিতে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেছে। 

সে কারণেই বলছি, গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার দৃঢ় ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে সেটি এখনও পুরোপুরি টেকসই ভিত্তির উপর পৌঁছায়নি। এর গতিময়তা আন্তর্জাতিক ও দেশিয় নানা সঙ্কটে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। নানা ষড়যন্ত্র চলছে। এর সুবিধাগুলো লুটেপুটে নিতে এখন দেশি ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়েই আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রযাত্রাকে সচল রাখতে হবে। সেখানে আবেগতারিত হলে কিংবা ভুল করলে ১৫ বছরের অর্জন ১৫ মাসেই তছনছ হয়ে যেতে পারে। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান আমাদের খুব কাছে থেকে দেখা অভিজ্ঞতা। ১৭-১৮ কোটি মানুষের এই দেশে নেতৃত্বের সামান্য ভুলের পরিনতি কতো ভয়াবহ হতে পারে তা সকলকেই খোলা চোখে দেখা থেকে বুঝে নিতে হবে। অর্জনের লড়াইটা কতো কষ্ট, ত্যাগ ও বিপুল বিনিয়োগের মাধ্যমে হয়েছে সেটি বুঝতে হবে কিন্তু ভুলের খেসারত দিতে হলে তখন এর কিছুই বুঝে ওঠার সুযোগ থাকবে না। সুতরাং সকলকেই সাবধানী হতে হবে। পরিচিতি : শিক্ষক ও কলামিস্ট। অনুলিখন : মোস্তাফিজুর রহমান      

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়