শিরোনাম
◈ কুমিল্লায় ব্যবসায়ী হত্যা মামলায় ৭ জনের মৃত্যুদণ্ড, ৭ জনের যাবজ্জীবন ◈ গোপনে ইসরায়েলে অস্ত্র পাঠাচ্ছে ভারত, জাহাজ আটকে দিয়েছে স্পেন ◈ দ্বিতীয় ধাপে উপজেলা নির্বাচন: ৬১৪ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ৪৫৭ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন ◈ উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে ৭১ শতাংশ প্রার্থী ব্যবসায়ী, কোটিপতি ১১৬ জন: টিআইবি ◈ ৩ বাসে ভাঙচুর, ট্রাফিক বক্সে আগুন, গুলিবিদ্ধ ১ ◈ ঢাকা মহানগরীতে ব্যাটারি-মোটরচালিত রিকশা চললেই ব্যবস্থা: বিআরটিএ ◈ বান্দরবানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ কেএনএফের ৩ সদস্য নিহত ◈ সৌদি বাদশাহ সালমান অসুস্থ, নেওয়া হয়েছে ক্লিনিকে ◈ সাঁতারের পোশাকে প্রথম ফ্যাশন শো সৌদিতে ◈ তৃতীয় দেশ দু-একশ জনকে আশ্রয় দিয়ে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ছাড়তে উৎসাহিত করছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী 

প্রকাশিত : ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ০১:২৮ রাত
আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ০১:২৮ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং ঝুঁকি

গোলাম সারোয়ার

গোলাম সারোয়ার: বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে ইদানীং দুই ধরনের কথা চালু রয়েছে। একটি হলো, বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি অলৌকিক সময় পার করছে। অন্যটি হলো, বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি ঝুঁকির বাঁক অতিক্রম করছে। প্রথম কথাটি মূল্যায়ন করেছে স্বয়ং বিশ্বব্যাংক। সর্বশেষ টাইম ম্যাগাজিন ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের সংখ্যায় বাংলাদেশকে নিয়ে চার পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে তারা উল্লেখ করে, বাংলাদেশ গত এক দশকে নিম্নআয়ের দেশ থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বর্ধনশীল অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। দেশটি বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় হার ৭ শতাংশে ধরে রেখেছে।

দ্বিতীয় দলের প্রশ্ন হলো, তাহলে বিশ্বব্যাংক থেকে বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নিতে হচ্ছে কেন? কেন দেশে জিনিসপত্রের দাম মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে? কেন ব্যবসায়ীরা নির্বিঘ্নে আমদানি করতে পারছেন না, কেন ডলারের বিপরীতে টাকার মান পড়ে যাচ্ছে? স্বীকার করতে হবে যে, বৈশ্বিক এবং দেশীর অর্থনীতির তথ্য-উপাত্ত আমলে নিলে দুই গ্রুপের দাবিই সত্য। এটি সত্য যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি গত পাঁচ দশকে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। 

স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে আমাদের জিডিপির আকার ছিলো ৪ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। সে সময়ের ডলারের হিসাবে যা ছিলো ৬.২৯ বিলিয়ন ডলার। আর গত অর্থবছরে আমাদের জিডিপির আকার দাঁড়ায় ৪১৬.২৬ বিলিয়ন ডলার, যা টাকার অংকে হয় প্রায় ৩৫ লাখ ৩০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। সুতরাং টাকার হিসেবে তুলনা করলে পাঁচ দশকে আমাদের জিডিপি বেড়েছে প্রায় ৮২২ গুণ।

এখন আমাদের বুঝতে হবে জিডিপি জিনিসটা কী? জিডিপি হলো, একটি দেশের ভেতরে একবছরে যে পরিমাণ দ্রব্য এবং সেবার সৃষ্টি হয় তার বাজার মূল্য। আর আগের বছরের তুলনায় পরের বছর এ উৎপাদন যে হারে বাড়ে তাই হলো জিডিপির প্রবৃদ্ধি। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছিল আড়াই শতাংশ। আর সর্বশেষ এখন আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হলো ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। মাথাপিছু আয় হয়েছে ২ হাজার ৮২৪ ডলার। মাথাপিছু আয় নিয়ে আমাদের আনন্দিত হওয়ার কারণ আছে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মানুষের বার্ষিক গড় মাথাপিছু আয় ছিলো ৯৪ মার্কিন ডলার, টাকার হিসেবে যা প্রায় ৫৮০ টাকার মতো ছিলো। 

একটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে কোন লেভেলে আছে সেটা হিসাব করা হয় মাথাপিছু আয় বিবেচনায় নিয়ে। বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘ আলাদাভাবে পৃথিবীর দেশগুলোর শ্রেণিবিন্যাস করে। যে রাষ্ট্রে মাথাপিছু আয় ১,০৮৬ ডলারের কম, তাকে নিম্ন অর্থনীতির দেশ বলা হয়। মাথাপিছু আয় ১,০৮৬ থেকে ১৩,২০৫ ডলারের মধ্যে থাকলে তাকে মধ্যম আয়ের দেশ বলা হয়। আর মাথাপিছু আয় ১৩,২০৫ ডলারের উপরে যে দেশগুলো সেগুলো উচ্চ আয়ের দেশ। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে অবস্থান করছে। 

এটি সত্য যে, গত দেড় দশকে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি বিশ্বের সবার নজরে এসেছে। আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রায় সাতের ঘরে। রপ্তানি বাড়ছে, রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ছে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে। এটি আমাদের আশার কথা। আমাদের আরো বড় শক্তির কথা হলো, আমাদের অর্থনীতির ৎবংরষরবহপব শক্তি। এটি হলো যেকোনো পরিস্থিতি থেকে ঘুরে স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তনের শক্তি। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, কোভিড-১৯ মহামারির অভিঘাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৫১ শতাংশে নেমে আসে, যা তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম ছিলো। সেই আমাদেরই গত অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি পৌঁছে গেলো সাতের উপরে। 

এখন কথা হলো, সব ইন্ডিকেটরে আমাদের পরিস্থিতি ভালো হলে আমাদের বাজার পরিস্থিতি খারাপ কেন? কেন আমাদের আইএমএফ থেকে ঋণ নিতে হয়েছে। এর কারণ হলো, আমাদের উচ্চাকাক্সক্ষা। আমরা মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশে উন্নীত হতে চাই। এটি করতে হলে আমাদের প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে অবকাঠামোখাতে এবং শিল্পখাতে। বাংলাদেশ করছেও তাই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এড়ানোর সুযোগ বিশ্বের প্রায় কোনো দেশেরই নেই। বাংলাদেশও যেহেতু বিশ্বের বাইরের কোনো দেশ নয়, তাই আমাদেরও এই রিয়েলিটির ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। 

যুদ্ধের কারণে বহির্বিশে^র পণ্যের মূল্য বাড়ছে। সঙ্গত কারণেই আমাদের আমদানি খরচ বেড়েছে। তার উপর অবকাঠামোতে প্রচুর বিনিয়োগ করতে হচ্ছে, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে বিদেশি ঠিকাদারী এবং টেকনোলজির সাহায্য নিয়ে। সেগুলোর পেমেন্ট দিতে হচ্ছে ফরেন কারেন্সিতে। এভাবেই আমাদের ফরেন রিজার্ভের উপর চাপ বেড়ে গেছে। এটি ভবিষ্যৎ উচ্চাবিলাস মাথায় রাখলে ঠিক আছে। তবে শুধু যে বিনিয়োগ আর আমদানির কারণে রিজার্ভ কমছে এটি ঠিক নয়। সত্য হলো, আমদানির আড়ালে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হচ্ছে এবং রপ্তানির বিনিময়ে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসার কথা সে পরিমাণ মুদ্রা আসছে না। তাছাড়া আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ডলার যেমন পাচার হচ্ছে, করও ফাঁকি দিচ্ছে অনেকে। এগুলো প্রতিরোধ করা আমাদের জন্যে একটি চ্যালেঞ্জ। এগুলো মোকাবেলা করতে হলে প্রথমে আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে, এগুলো হচ্ছে। তারপর যারা এগুলো প্রতিরোধ করবে তাদের জনবল ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। অবিরাম মনিটরিং বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, মনিটরিং না থাকলে একটি সভ্যতা গড়ে উঠতে বহু যুগ লাগলেও তা ভেঙে যেতে সময় লাগে মাত্র কয়েক বছর। এটি ব্যবিলন থেকে রোমান সভ্যতা, সিন্ধুসভ্যতা থেকে পারস্য সভ্যতা পর্যন্ত বিস্তৃত সত্য। 

আমরা দেখেছি মধ্য আয়ের দেশ থেকে বিপদের দিকে ধাবিত হয়েছে শ্রীলংকার মতো দেশ। তাই মধ্য আয়ের আত্মতৃপ্তি নিয়ে আমাদের বসে থাকলে চলবে না। একটি অর্থনীতির নিরপেক্ষ অন্তর্নিহিত শক্তি হলো, জাতির সবারে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে সমানতালে। এখানে কোনো দল, কোনো শ্রেণি কিংবা কোনো গোষ্ঠী যেন বিশেষ সুবিধা অবিরাম পেতে না পারে। তবেই আমাদের অর্থনীতি দাঁড়াবে মজবুত ভিত্তির উপর। আইএমএফের ঋণ নেওয়া হয়েছে তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা, দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সমস্যা অনুকূলে আনা, প্রবৃদ্ধির গতি বাড়ানো, বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর দিকগুলো মাথায় রেখে।

অনেকের অভিযোগ স্বীকার করে বলতে হয়, নিজেদের থাকলে কেউ কি আর ঋণ করে। এটি সত্য। তবে অর্থনীতিতে এর বাইরেও কিছু সত্য থাকে। আইএমএফ নিজেও একটি ব্যাংক। ব্যাংক সাধারণত সেখানেই অর্থ বিনিয়োগ করে যেখান থেকে সুদসহ তার অর্থ ফেরত আসার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। সে হিসেবে আইএমএফের ঋণ প্রাপ্তি আমাদের স্বস্তি দেবে এই টেস্টে যে, আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক এলাকাগুলো শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এখনো। 

শেষ করার আগে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফের সর্বশেষ বক্তব্যটির রেশ টানবো। শিয়ালকোটের একটি বেসরকারি কলেজের এক অনুষ্ঠানে খাজা সাহেব বলেন, ‘পাকিস্তান ইতোমধ্যে ঋণখেলাপি হয়ে গেছে এবং আমরা এক দেউলিয়া দেশে বাস করছি। দেশের প্রায় সবাই এর জন্য দায়ী। ক্ষমতাচক্র, আমলাতন্ত্র, রাজনীতিবিদÑসবাই।’ তার মানে পাকিস্তানের কর্তারাই স্বীকার করে নিলেন দেশটি ইতোমধ্যে দেউলিয়া হয়ে গেছে। দেশটির মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে রীতিমতো যুদ্ধ করছে। এরই ভেতরে আরেক ঘটনাও কিন্তু দেশটিকে ঘটেছে। ১০ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিক্রয়কেন্দ্র খুলেছে কানাডার নামি কফি ব্র্যান্ড টিম হর্টন। সেখানে সর্বক্ষণ ক্যাফের বাইরে দেখা যাচ্ছে কফির জন্য অপেক্ষমাণ মানুষের দীর্ঘ সারি। তার মানে কী? মানে হলো একটি দেশ যখন দেউলিয়া হয় তখনও দেশটির বিলাসদ্রব্যের দোকানে দোকানে থাকে ধনী মানুষদের দীর্ঘ সারি। এটি কেন বললাম। আমাদের দেশেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যখন মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়, অনেকে বলে থাকেন তাহলে গুলশান, ধানমন্ডির রেস্টুরেন্টগুলোতে এতো মানুষ কেন? এটি কোনো যুক্তি নয়। এটি আমাদের মাথায় রাখতে হবে। 

পৃথিবীতে একটি অলৌকিক বাস্তবতা আছে। সেটা হলো, অনেক চেষ্টা প্রচেষ্টার পরেও আর্থিক ব্যর্থতা এবং দারিদ্র্য শুধু ভাগ্যের দোষেও মানুষের আসতে পারে। সভ্যতার গতির সাথে তাল মিলাতে না পেরেও অনেককে দরিদ্র্য হয়ে পড়তে হয়, পড়তে হয় আঞ্চলিক ভৌগোলিক বাস্তবতায়। এ  ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সৃষ্টি করতে হবে। যারা পিছিয়ে পড়েছে তাদের সুরক্ষা দিতে হবে। ধনী-দরিদ্র্যের ব্যবধান কমাতে হবে। না হলে মানুষের মাঝে যদি শ্রেণি ঘৃণা উসকে উঠে তাহলে কোনো সভ্যতাই টিকে থাকতে পারবে না। কারণ সভ্যতা গড়ে তোলে মানুষ। সভ্যতা টিকিয়ে রাখেও মানুষ। সাংবাদিক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়