অধ্যাপক ডা. মো. তাজুল ইসলাম: আমরা সবাই নুহ আ. (নোয়াহ) এর সময়ের ‘মহাপ্লাবনের’ কথা জানি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরকম মহাপ্লাবনের ইতিহাস প্রায় সব জাতির মধ্যেই পাওয়া যায়।
যেমন: [১] সুমেরীয় মহাপ্লাবন: ‘এসিরীয়’ লাইব্রেরীতে ‘আক্কাদিয়ান’ ভাষায় (একটি সেমেটিক ভাষা) রচিত একটি বইতে এরকম ‘মহাপ্লাবনের’ কথার উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা হয়, দেবতাদের রাজা ‘এনলিল’ মানব জাতির উপর বিরক্ত হয়েছিলেন, কেননা তারা প্রতিনিয়ত শব্দ সৃষ্টি করে ‘এনলিল’ এর নিদ্রার ব্যাঘাত করতো। তিনি অন্য দেবতাদেরও রাজি করান পৃথিবীর বাসিন্দাদের শায়েস্তা করার জন্য। তবে ‘ইয়া’ নামক এক দেবতা ছিল মানব দরদী। তিনি দেবতাদের এরকম চক্রান্তের কথা ‘উতনাপিশটিম’ নামে এক জ্ঞানী ব্যক্তিকে সেটি জানিয়ে দেন। এ খবর পেয়ে উতনাপিশটিম নৌকায় করে পালিয়ে গেলেন- সাথে নিলেন পরিবার ও কিছু প্রাণী।
[২] ব্যবলনীয় (মেসোপোটেমিয়া) মহাপ্লাবন: প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান রাজা ‘আত্রাহাসিস’কে তেমন একটি মহাপ্লাবনের বিষয়ে সতর্ক করা হয়। তিনি একটি বড় জাহাজ নির্মাণ করেন এবং দেশের জনগণকে ডেকে একটি ভোজসভা আয়োজন করেন। কিন্তু অন্তিম সময়ের এরকম খানাপিনা জনগণের কাছে বিস্বাদ লাগে। রাজা নিজেও অস্থির হয়ে পায়চারি করতে থাকেন।
[৩] নুহ (আ.) (নবী নোয়াহ) এর মহাপ্লাবন: বাইবেলের ‘জেনেসিসে’ বলা হয়¬- সৃষ্টিকর্তা ঠিক করলেন তার সৃষ্টি সমূহকে কলুষমুক্ত করবেন। তাই তিনি একমাত্র ‘নিষ্পাপ’ নোয়াহকে বললেন, একটি জাহাজ তৈরি করে তার পরিবারকে রক্ষা করতে। স্বর্গ থেকে ঝর্ণার ধারা নেমে এলো ও নোয়াহ যতো সম্ভব মানুষ ও প্রাণী নিয়ে নৌকায় চেপে বসেন। প্লাবন শেষ হওয়ার পর শুষ্ক মাটিতে ফিরলে নুহ (আ.) আনন্দে মাতালের মতন হয়ে গিয়েছিলেন। নোয়াহকে বলা হয়েছিলো, ‘এখন থেকে মাংসের জন্য পশুহত্যা করা গ্রহণ যোগ্য ঘোষিত হলো’।
[৪] চীন দেশে মহাপ্লাবন: সুমেরীয় আমলে চীন দেশে দুটি স্বতন্ত্র চাষাবাদ ভিত্তিক কৃষ্টি তৈরি হয়েছিল- ‘ইয়াং শাও’ ও ‘লংশান’ নামে। তাদের বর্ণনা মোতাবেক: একজন বিশ্বাসঘাতক নেতা আকাশের বুক চিরে ফেলাতে শাস্তি স্বরূপ পুরো পৃথিবীকে বৃষ্টির পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শুধু একজন মহীয়সী নারী ও তার অল্প কিছু সহযোদ্ধা একটি পাহাড়ের চূড়ায় আশ্রয় নিয়ে বেচে গিয়েছিলেন।
[৫] ভারতের মহাপ্লাবন: ‘বিজ্ঞ রাজা ‘মানুকে’ একটি মাছ সতর্ক করে দিয়েছিল যে একটি বিশাল আকারের বন্যা আসছে এবং তার উচিত হবে একটি বড় জাহাজ তৈরি করে তাতে চড়ে বসা। বেদে বলা হয় ত্রি স্বর্গ তলিয়ে গিয়েছিল পানির নীচে, আর শুধু মানু একাই বেচে গিয়েছিলেন।
[৬] মায়াদের মহাপ্লাবন: এতে বলা হয় ‘চার শত মানুষ’ বেচে গিয়েছিল ‘মাছে’ রূপান্তরিত হয়ে। পরে মাছ থেকে তারা আবার মানুষে রূপ নেয় ও এই আনন্দে তারা ‘মাতালের’ মতন উৎসব করেন। যেমন করেছিল নুহ (আ.) (নোয়াহ)
[৭] পেরুতে মহাপ্লাবন: একদিন এক ‘লামা’ তার নিয়মিত বরাদ্দ খাবার খেতে অস্বীকার করে। অবাক হয়ে তার মালিক জানতে চায় কেনো সে এমন করছে? তখন লামা তাকে সতর্ক করে দেয় যে আর ৫ দিনের মাথায় বিশাল জলরাশি পৃথিবীকে গ্রাস করবে। মানুষটি তখন পাহাড়ের চূড়ায় আহরণ করেন ও প্রাণে বেচে যান। পরে পৃথিবীতে পুনরায় জনমানব পূর্ণ করে তুলেন (মজার বিষয় ওই সময় কোনো মহিলা তার সঙ্গে নিয়ে যাননি। তাহলে কীভাবে মানুষ জন্ম দিলো?)। যাহোক এসব কাহিনির মধ্যে বেশকিছু বিষয়ে মিল রয়েছে। আর এতগুলো কাহিনি ভুল সেটি ভাবাও কঠিন। এসব নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, অনেক মতবাদ দেওয়া হয়েছে- সেসবই জটিল ও বিতর্কিত। এ নিয়ে পরে কথা বলা যাবে। লেখক: মনোবিদ
আপনার মতামত লিখুন :