অজয় দাশগুপ্ত, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া থেকে : শেখ রাসেল একটি অনুভূতির নাম। বালক বেলায় অপ্রত্যাশিত মৃত্যু তথা হত্যার নায়ক রাসেল। যারা তাকে মায়ের কাছে পাঠানোর নামে অন্য কোথাও পাঠাতে চেয়েছিল সেসব ঘৃণ্য খুনিরা বুঝতেই পারেনি তারা ওকে পাঠিয়ে দিয়েছে অমরত্বে। নিরীহ বালক রাসেল রাজনীতি জানতো না। অপরাধ করার বয়সও হয়নি তার। এমন নিরীহ নিরপরাধ কাউকে বুলেটে ঝাঁঝরা করা কোন বীরত্বের নমুনা? মূলত এসব ঘৃণ্য খুনিরা কিলিং এজেন্ট এবং তারা বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে নিঃশেষ করার নামে দেশ ও জাতিকে হত্যা করতে চেয়েছিল। তাদের ষড়যন্ত্র শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। আজ রাসেল ও তার পরিবার বন্দিত। অন্যদিকে আত্মস্বীকৃত খুনিরা ঘৃণিত। দেশ ও জাতির কাছে তাদের নাম কেবলই খুনি। এরা তো বিদায় নিয়েছেই তাদের পরিবার পরিজন সন্তানেরা ও পিতৃ পরিচয়ে বাঁচতে ঘৃণা বোধ করে। এরচেয়ে বড় শাস্তি আর কি হতে পারে?
রাসেল বড় হলে কী হতো, হতে পারতো সে কথা এখন অবান্তর। এটা ই সত্য তাকে বাঁচতে দেওয়া হয়নি। আজকাল শোকও কেমন বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। এখন গান গাওয়া হয়, যদি রাত পোহালে শোনা যেতো বঙ্গবন্ধু মরে নাই... এই আবেগের সিকি ভাগও সেদিন চোখে পড়েনি। তবে সময় থেমে থাকেনি। সে তার প্রতিশোধ নিয়েছে। সময়ের চাকা ঘুরে এখন রাসেলই হিরো। তাকে ঘিরে সারাদেশ জেগে থাকে। তার জন্য শোকের পাশাপাশি মনে মনে যে ভালোবাসা তার ভেতরেই জেগে থাকবে শেখ রাসেল।
এতবছর পর তার জন্য ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সাথে কিছু দায় দায়িত্ব ও থাকে বৈকি। দেশের সব শিশুদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করার পাশাপাশি তাদের জীবন সুরক্ষিত রাখা রাষ্ট্র ও সমাজের কর্তব্য। এদেশে যতোদিন একজন শিশুও অভুক্ত থাকবে, নিরক্ষর থাকবে বা ভয়ে থাকবে ততোদিন রাসেলের আত্মা শান্তি পাবার কথা নয়। যে শিশু বুদ্ধি বিকশিত হবার আগেই চলে গিয়েছিল যেতে বাধ্য হয়েছিল তার আর কি চাওয়ার থাকতে পারে?
শেখ রাসেল দিবস পালনের অঙ্গীকার এটাই হওয়া উচিত। সবসময় মনে রাখতে হবে এই দেশে যেন এমন কোনো ঘটনা আর কোনো কালে না ঘটে। এমন ন্যাককারজনক ঘটনাকে যারা প্রশ্রয় দেয় বা নীরবেও মুখ বুঁজে হজম করে তাদের জন্য ঘৃণার সাথে চাই প্রতিরোধ। কারণ এরাও খুনির দোসর।
শেখ রাসেলকে নিয়ে বলা বা লেখাকে যারা দলবাজি কিংবা রাজনীতি মনে করে তারা মতলববাজ। জানি অনেকে এখন নানা কারণে উদ্দেশ্য হাসিলে এমন করে কিš‘ তারা শেষ কথা না। শেষ কথা হত্যাও শিশু হত্যার বিরোধিতা। যা করা না গেলে দেশ সমাজ কিছুই টিকবে না। এগিয়ে যাওয়া ও টিকে থাকার তফাৎ এটাই। টিকতে হলে রাসেলকে সম্মান করত হবে। শিশু পুত্রের এই বলিদান বাংলা মা সহজে নিতে পারেননি। পারবেনও না। আমাদের বিভাজিত রাজনীতি শোককে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। সে কারণেই রক্তমাখা কেক কাটা হতো শোক দিবসে। এখনো বিভাজনের কারণেই রাসেলের মতো শিশুর হত্যাকাণ্ড রাজনীতির শিকার হলে একবাক্যে সবাই স্বীকার করতো রাসেল ই আমাদের যীশু। আমাদের দেবশিশু।
এত বছর পরও মনে হয়, কেন রাসেলের এমন হলো না যে, তিনিও আশ্রয়ের পরম নিরাপত্তায় বড় বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার হাত ধরে জার্মানি পাড়ি দিতে পারতেন; তাহলে তাকে আর হারাতে হতো না সম্ভাবনাময় এক জীবন। মায়ের কাছে যাবার চাওয়াটি পূরণ করেনি ঘাতকের দল। তারা কি পারতো না এই মাসুম বা”চাটিকে ছেড়ে দিতে? কেন দেয়নি তা আজ আর কোনো ব্যাখ্যার ধার ধারে না। সবাই বোঝে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সমূলে বিনাশই ছিল এর মূল কারণ। তারা বঙ্গবন্ধুর রক্তকে ভয় পেতো। জানতো এই অবিনাশী রক্তের ধারা যতদূর যাবে ততো দূরই রচিত হতে পারে নয়া ইতিহাস। শেখ রাসেলের মতো শিশুকেও তাই ছাড় দেয়নি ওরা। হয়তো আজ শেখ রাসেলই হতো আমাদের দেশের বড় নেতা। বঙ্গবন্ধুর পুত্র তাঁর মতোই গর্জে উঠতো বজ্রকণ্ঠে । সেসবই বুলেট স্তব্ধ করে দিয়েছে।
শেখ রাসেলের হোম টিচার গীতালী দি থাকেন সিডনিতে। সম্প্রতি তাঁর স্বামী লোকান্তরিত হয়েছেন। সেদিন সেই শোকের সময় ও তিনি রাসেলের কথা বলতে ভোলেননি। তাঁর মুখে আমরা আমি রাসেলের যে বর্ণনা পাই তাতে এটা বোঝা কঠিন না এই ছেলে যেমন দূরন্ত ছিল তেমনি হয়ে উঠতো মেধা আর শ্রমের এক প্রতীক। সে সুযোগ যারা দেয়নি তাদের দূরভিসন্ধি সময় ব্যর্থ করে দিয়েছে। আজ শেখ রাসেলের বড় আপা আমাদের নেতা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের কান্ডারি। তাঁর হাতে নিরাপদ আমাদের ভবিষ্যত। আমাদের ইতিহাসকে বহুভাবে নিন্দিত আর কলঙ্কিত করার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন তিনি। এবার আমাদের বিনীত নিবেদন আপনি শেখ রাসেলের নামে তার স্মৃতিতে এমন কিছু করবেন যা সব প্রচার বা প্রচারণার বাইরে এক অনিন্দ্যসুন্দর নির্মাণ।
যাতে আবে থাকবে তার চেয়েও বেশি থাকবে রাসেলের মতো শিশুদের ভবিষ্যৎ। যাতে আমাদের দেশের শিশুরা জ্ঞানে বিজ্ঞানে বড় হয়ে এমন একটা হারিয়ে যাওয়া শিশুর জন্য গর্ববোধ করবে। দেশ ও দেশের বাইরের বাঙালি জানবে এদেশে শেখ রাসেলের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। এমন প্রত্যাশা কি খুশিশু শিকার হয়েছিল রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের । ভাবা যায় না এমন মাসুম বাচাকে কেউ গুলিতে মারতে পারে। সেই নিষ্ঠুর জল্লাদের সমর্থক বা সহানুভূতিসম্পন্নদের আমি ঘৃণা করি। এ কোন রাজনীতি না এ হচ্ছে মানবতা। আর মানবিক কারণেই আমরা শেখ রাসেলের হত্যাকারীদের চাই না। চাই শিশু হত্যা মুক্ত এক নির্মল সমাজ। যেখানে সবশিশু বেড়ে উঠবে নিরাপদে। আমাদের মায়ার সমাজে আর কোনোকালে যেমন কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে। আমাদের দেশ ও জাতি যেন এই রক্তের সম্মান আর ভালোবাসার প্রতিদান দিতে শেখে । সে কামনা করে প্রয়াত রাসেলের আত্মার শান্তি কামনা করি । শুভ জন্মদিন শেখ রাসেল।
লেখক ও কলামিস্ট