গুলজার হোসেন উজ্জ্বল: পিলু প্রাচীন হিন্দি ভাষার একটি শব্দ। এর অর্থ মিলন। মিলন মানে যেন তেন সাধারণ মিলন নয়। শৃঙ্গার সহ মিলন। অর্থাৎ গভীর প্রেমের মিলন। মৈথুনও বলতে পারেন। কোকিল মিলনের উদ্দেশে তার সঙ্গীকে আহ্বান করে গানের সুরে ডাকে। এমন কোকিলকে দুষ্টু কোকিল বলে ডাকাই যায়। পিলু নামে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের একটি রাগ আছে। খুবই জনপ্রিয় রাগ। এই রাগ ঠুমরিতে ব্যাবহার হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ঠুমরি মূলত প্রেম রসের গান। সেকালে নব্য বাবুদের মনোরঞ্জন করতে কোঠিওয়ালি গায়িকারা ঠুমরি গাইতেন। কারণ নব্য বাবুদের খেয়াল শোনার ধৈর্য্য ছিলো না। তারা অতটা সংগীতে সিদ্ধ ছিলেন না। তারা ৩-৫ মিনিটের একটা শর্টকাট বিনোদন চাইতেন।
কোনো একজন মশহুর উস্তাদকে একবার ঠুমরি গাইতে অনুরোধ করা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘ইয়ে তো গিদ্ধার কি গানা, তিন মিনিট পার খাতাম হো জায়েগা’! এসব গাধাদের সংগীত তিনি গাইবেন না বলে রাগ দেখিয়েছিলেন। পরে তিনিই হয়ে উঠলেন ঠুমরির এক অবিস্মরণীয় শিল্পী। সম্ভবত বড়ে গুলাম আলী খাঁর গল্প এটি। ঠিক মনে পড়ছেনা। পিলু রাগে একটা বিখ্যাত গান আছে বেগম আখতার জির। জোছনা করেছে আড়ি। পিয়া ভোল অভিমান- বিখ্যাত ঠুমরি। বড় গুলাম আলী খাঁ গেয়েছেন। বাংলা ভারসন গেয়েছেন বেগম আখতার, অজয় চক্রবর্তী। নজরুলও লিখেছেন অসংখ্য গান। সুরে ও বানীর মালা দিয়ে তুমি আমারে ছুঁইয়াছিলে। আহা। পিলুর প্রেমরসঘন মেলোডি হৃদয় এফোড় ওফোড় করে দেয়।
‘পিয়া ভোল অভিমান’Ñএর হিন্দি/উর্দু ভারসনটি একবার শুনেছিলাম সন্ধ্যা মুখার্জির কণ্ঠে। তান বিস্তার করে একটু সময় নিয়ে গেয়েছিলেন। অনেক বছর আগের কথা। শুনেছিলাম কলকাতার মির্জা গালিব স্ট্রিটের একটা সস্তা হোটেলের ছাদে, রেডিওতে। হোটেলের একজন কর্মচারি অনেক রাতে ছাদে বসে শুনছিলেন। আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম। তিনিই বললেন, এটা আকাশবানী থেকে প্রচার করছে। সন্ধ্যা জির গাওয়া। তাঁর কাছে জানলাম সন্ধ্যাজি নাকি ২৬ সাল ক্ল্যাসিক্যাল তালিম নিয়েছিলেন বড়ে গুলাম আলী খাঁ সাহেবের কাছে। সেই কর্মচারী ভদ্রলোকের বাড়ি ছিল ইউপি। ভদ্রলোককে মনে পড়ছে। একা থাকতেন কর্মক্ষেত্রে। পরিবার, প্রিয়জন ইউপিতে। ইউপির কোথায়? হবে হয়তো লখনৌ, নয়তো এলাহাবাদ।
পিলু প্রেমের রাগ। মিলনের রাগ। বসন্তের রাগ। মিলন উন্মুখ কোকিলের রাগ। ‘দুষ্টু কোকিল’ বলে সম্প্রতি একটি পার্টি সং খুব জনপ্রিয় হয়েছে। বাংলার সুপারস্টার সাকিব খানের তুফান সিনেমার গান এটি। মিশ্র পিলু রাগের সুর। কোমল গা ছুঁয়ে এসে উদারার নি অব্দি নেমে আবার শুদ্ধ গা তে থামে। শরীরটা প্রচণ্ড খারাপ। গলা ততোধিক খারাপ। কাজে মন লাগছে না। পিলু রাগ কয়েকদিন যাবৎ মাথায় ঢুকে গেছে। একটা ম্যাশ আপ করা যেত। বারসান লাগি সাবান বুন্দিয়া রাজা, জোছনা করেছে আড়ি, আমারে ছুঁইয়াছিলে, দুষ্টু কোকিল। গলা খারাপ বলে গাইতে পারছি না। সুর কেমন করে কালাকাল আর জাত অজাতের মাঝে সেতু হয়ে দাঁড়ায়। সুরের নেশা যারে পায়, তার আর মুক্তি নেই। লেখক : চিকিৎসক