ইকবাল আনোয়ার: আমাদের শৈশবে মসজিদের মিনারে বাতি জ্বলতো ইফতারের সময়। মসজিদে মাইক ছিলো না। আজানের ধ্বনি বেবি দূর যেতো না। নুনাবাদের সাইরেন এসেছে অনেক পরে। আমরা রিকোইজিশন বাসার ড্রামকাটা গেইটের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মসজিদ বরাবর তাকিয়ে থাকতাম আকাশে পথে। পাক ঘর থেকে মুশুরের ডালে অল্প তেলের সাশ্রয়ে বড়া ভাজার গন্ধ আসতো। একটা রোজা রাখার কী যে আনন্দ। সেদিন নিজেকে বিরাট পরেহেজগার মনে হতো। আম্মা বলতেন, দুপুরে খেলেও ছোটদের রোজা হয়। কথাটা ঠিক বিশ্বাস হতো না। লাল বাতি জ্বলা মাত্রই সারাপাড়া জুড়ে বালক-বালিকার মিলাত কণ্ঠে আনন্দ বার্তা ধ্বনিত হতো- লাল বাতি জ্বইল্লা গেছে। মানে ইফতারের সময় হয়ে গেছে। সে ইফতারীর কী যে আনন্দ। রোজা এলে পড়ালেখায় অতো কড়াকড়ি নেই। শীত কালের রোজা যেনো আরও মহত্বর আনন্দের। দুদু মিয়া সেহরীর সময় ডাকতো-রোজা রাখো, মমিন জাগো। রোজায় ডাকডাকির জন্য সারা বছর তার গলা বসা থাকতো, হেস হেস কথা বলতো সে। প্রতি ঘরে, প্রয়োজনে ঘরের পেছন দিক দিয়ে কলা গাছের ঝোঁপ পেড়িয়ে আমাদের সিথান বরাবর ডাকতো দুদু মিয়া। ঘর থেকে জেগে উঠার সংকেত না শোনে সে যেতো না। তারপরেও কোনোদিন, গভীরভাবে সবাই কাতর নিদ্রানেশায়।
রজনী প্রভাতে জেগেই, ‘আহারে’ বলে দুঃখে আহজারি দিতেন আব্বা। কতক ইশরাকে দুর আজানের ধ্বনি শোনে জাগতো বড়োরা। তখন ছোটদের ডাকার কথাই উঠে না, কোনোমতে নাকে মুখে কিছু গুজে নিয়ে পানি খাওয়াই এখন কাজ। লোম খাড়া না হওয়া পর্যন্ত খাওয়া যায়, এ ফতোয়া দাঁড় করানো হতো। রোজার মাসের শেষে ঈদ। আনন্দের বারতা। রোজা আর ঈদ গেলে, আবার পুরানো দিন। মন খারাপ হতো। আম্মার কষ্ট বেশি। শেষ রাতের নামাজতো পড়তেনই তিনি। এরই মধ্যে আগে জেগে ভাত বসাতেন, তরকারী গরম করতেন, সবাই যেনো ‘তার’ করে খেতে পারে। টক দই, খেজুরের গুড়ে মেখে শেষ পাতে ভাতের সঙ্গে খাওয়া, এটাই বড় বিলাশিতা আম্মার। সেসব দিনে সরল জীবনে, গরিবীআনার কালে, কোথা থেকে এতো কষ্ট করে, আমাদের পিতা-মাতা আমাদের আনন্দের জন্য সব কষ্ট সয়ে যেতেন। আমরা কি এসব তখন বুঝতাম। তারা প্রত্যেককে পোশাক, জুতা দিতে গিয়ে নিজেরা কিছু নিতেন না। তারপর ও গ্রামের বাড়ির প্রতি খেয়াল রাখতে হতো। এমন কঠোর হিসাবে তাদের প্রাণান্ত কাটছাট করার কসরত আমরা তখন কি টের পেতাম। পেতাম না। আমরা তখন আনন্দটাই উপভোগ করতাম।
আমাদের পাড়ায় দুই ঘর মাত্র আমরা মুসলমান। বাকিরা হিন্দু। আর যেটা দুই তলা বাড়ি, তাদের জৌলুস টের পাওয়া যেতো না। তারা এদিকে মিশতো না। দেখতাম, তাদের রয়েছে জনা দুই তিন বাবুর্চি। তারা উচ্চশ্রেণির। তাদের সঙ্গে তুলনা দেওয়ার কথাই উঠে না। ফলে আমরা টের পেতাম না, কি কি নেই জীবনে আমাদের। আমাদের ছিলো কালিমাখা হাড়িকেন- জীবন। আমরা তখন সুখি ছিলাম। কাগজের টুপি পরা বালকেরা ঈদে এক কাতারে দাঁড়াতো। অন্তত আমাদের টুপি কাপড়ের। তাতেও মনে হতো না আমার, যে তারা আমাদের চেয়েও প্রান্তিক। আমার ছিলো সিনেমার কাগজ জমানোর নেশা। রিক্সা থেকে পিছে ফেলে ফেলে যেতো সে কাগজ। মাইকে সিনেমার প্রচার করা ভরাট গলার রূপালী কথার ভোলা, সঙ্গে উড়ে আসতো এসব বিজ্ঞাপন কাগজ, তাতে ছবি নায়ক নায়িকার। আমি ছিলাম, ছড়ার আনন্দে বিভোর। রঙ্গীন সবকিছু। চারপাশে পুকুর ডোবা, জংগল। এর মাঝখানে আমি ভাসি প্রকৃতি- বিভোর কিশোর, সিমেন্টের কাগজে পিতার বাঁধাই করে দেওয়া বইয়ের পাতায় সিন্ডারেল্লার জুতা কাহিনী পড়ে রুমান্টিক। চাটাই চেপ্টা একটি খেজুরের সে স্বাদ এখন আর পাই না। গরিবীয়ানা দূর হয়েছে বটে। কিন্তুু শৈশবের দিনগুলোর মতো ভালো দিন গিয়েছে বিদায় হয়ে। এখন এতো জটিল জীবন, এতো বিষাদ- বিমিশ্র রসায়ন, এতো তিক্ততা, এতো নিদারুণ শ্বাস ফেলার কসরত, নানা ঝঞ্ঝাট -ক্লান্ত অপেক্ষায় কাতর আমরা। আমাদের পিতারা তবে কি বাহাদুর ছিলেন না? এর চেয়ে হাজার গুণ বেশি কষ্টে আমাদেরকে লালন পালন করে, আজকের এ মর্যাদায় আমাদেরকে অধিষ্টিত করে আজ তারা কই।‘রাব্বি রহম হুমা কামা রাব্বাইয়ানি সগিরা।’ আমাদের এতো কিসের কষ্ট চিন্তা, কিসের নেই নেই হতাশা। এসবই নষ্ট চিন্তা মাত্র। আমরা আমাদের পিতা-মাতার দিকে যাচ্ছি।
এ রমজানে যতদূর খোলা হাত যতদূর যায়, ভালোবাসা, দান ততদূর ছড়িয়ে দিয়ে সুখ খোঁজে নিতে যেনো পারি, হে দয়াময়। তাহারা ঘাস নেয় পাতে, লেবুর রসে সে ঘাস খেয়ে ইফতার করে, পৃথিবীর মানুষ পারে না, জাতিসংঘ পারে না এ মর্মে আঘাত করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে। আর যারা মুসলমান দুম্বা নিয়ে বসেছে, গলা পর্যন্ত ভর্তি করতে, উভয় দলকে রহম করো। শুভ বুদ্ধি দাও প্রভু। আবার দেখি, এমন রমজানে, শয়তান বন্দি হওয়ার কালে, এক টুপিধারী, লম্বা কোর্তা, কেমন শয়তান, তার বিচার প্রকাশ্যে হোক, সে এক বালিকার গাল নখ দিয়ে কেটে যৌন চাহিদা মিটিয়েছে, সে শিশু যেনো আবার অবন্তিকার মতো আত্মহননের পথে না যায়, যে ভয় সে পেয়েছে, আর মানসিক যাতনা এন্তার, তা থেকে সে যেনো বের হয়ে আসতে পারে, কেননা, সে তো আমার সে শৈশবের দিনের শিশু, তারতো আনন্দ পাবার কথা এ রমজানে, এ ঈদে, সরিয়ে নিওনা, তার বুক থেকে সে আনন্দ, হে দয়াময়। আবার মিনারে মিনারে লাল সংকেত জ্বলুক। এ সমাজ পাল্টে ফেলতে হবে, এ যে জুলুমের সমাজ। রমজানের এ শিক্ষা জ্বলে উঠুক, বাংলার সব মানুষের ঘরে ঘরে। লেখক: চিকিৎসক