মঈন চৌধুরী: ছেলেবেলায় মার মুখে একটি ঘুমপাড়ানিয়া গান শুনেছিলাম, গানের কথাগুলো ছিল, ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে। একটু বড় হবার পর নিজেই ছড়াটি পড়ে মনে হয়েছিল, ছড়ার প্রথম পঙক্তিটিতেই আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যা আমাদের সমাজ-মনস্তত্ত্বের অংশ হয়ে এখনও সত্য। ছেলে ঘুমালে পাড়া জুড়ায়, ডানপিটে ছেলেদের হাত থেকে পাড়াপড়শিরা কিছুটা স্বস্তি পায়, এ সত্য অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু প্রশ্নটা হলো, একটা মেয়ে না ঘুমালে কী হয়? একটা মেয়ে না ঘুমালে কিছুই আসে যায় না। কারণ সে তো সবসময় জেগেও ঘুমিয়ে আছে। আর যদিও বা জেগে থাকে, তবুও তার পা রান্নাঘর পেরিয়ে বড়জোর উঠোনে যাবে, যদি আরো একটু বেশিদূর যায় তবে তা কোনোভাবেই পুকুরঘাটের শেষ ধাপ পেরিয়ে অন্য কোথাও যাবে না।
ছড়ার পঙক্তিটি পড়ে আরও কিছু মৌলিক প্রশ্ন আসতে পারে। মৌলসত্তার অধিকারী এক ছড়াকার ইতিহাসের হারানো কোনো একদিনে বসে ছড়াটি কি শুধু ছেলেদের ঘুম পাড়ানোর জন্য লিখেছিলেন? মেয়েদের ঘুম পাড়ানোর জন্য কি মায়েদের ছড়াগান গাইতে হয় না কিংবা নিয়ম নেই? জেগে থেকে শিশুসুলভ দুষ্টুমি করার কিংবা চঞ্চল থাকার অধিকার কি মেয়েদের থাকতে পারে না? সাধারণ জ্ঞান প্রয়োগ করে প্রশ্নগুলোর উত্তর যদি আমরা দিই তবে বলব, ছড়াটি ছেলেমেয়ে দুজনের জন্যই লেখা, মায়েরা ছেলে কিংবা মেয়ে যা-ই হোক না কেন, ছড়াগানটি গাইতে পারে; আর একটি মেয়েরও শিশুসুলভ দুষ্টমি, চঞ্চলতা থাকতে পারে। মানুষ যুক্তিবাদী, তবুও মৌলসত্তা অধিকারী ছড়াকার শুধু ‘ছেলে’ ঘুমানোর কথা বললেন কেন? মানুষের সত্তার উচ্চারণ যেহেতু বাচাল বক্তব্য রাখে না, তাই আমরা বলতে পারি, আমাদের ওই ঐতিহাসিক ছড়াকারের মনস্তত্ত্ব পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা আর আইনকানুন দিয়ে প্রভাবিত ছিল।
বাংলাদেশের জনগণকে ঐতিহাসিকভাবেই বলা হতো বঙ্গাল বা বাঙাল, আর এই বাঙালদের সমাজসংগঠন সবসময় ছিল পুরুষতান্ত্রিক। সন্তানগর্ভে আসলেই সবাই একটা ‘ছেলে’-সন্তান কামনা করত আর কন্যাসন্তানের জন্ম হলেই বজ্রপাত হতো কন্যাসন্তানের পরিবারে। যে মেয়েসন্তান জন্মের সময়ই অভিনন্দিত হয়নি, তার ভাগ্যে পরবর্তীকালেও জুটত অবহেলা আর গঞ্জনা। সমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদী কৌলীন্যপ্রথা থাকার কারণে শৈশবকালেই কন্যার বিবাহ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়তেন বাবা আর মা। কন্যাসন্তান একটু চঞ্চল হলে, দুষ্টুমি করলে তা মা খুব স্বাভাবিকভাবেই ঝাঁটার বাড়ি দিয়ে ‘জন্মের সময় তুই মরলি না কেন?’ বলতে দ্বিধা করত না। এ প্রসঙ্গে ড. অতুল সুর লিখেছেন, ‘যে সমাজে কৌলীন্যপ্রথা প্রচলিত ছিল ও মেয়েকে অপসারণ করবার একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি পিতামাতার মনে জেগেছিল। সেজন্য গঙ্গাসাগরের মেলায় নিয়ে মেয়েকে সাগরের জলে ভাসিয়ে দেওয়াটা এ দেশে একটা প্রথায় দাঁড়িয়েছিল। ... অনেক আবার মেয়েকে সাগরের জলে ভাসিয়ে না দিয়ে, মন্দিরের দেবতার নিকট তাদের দান করতেন।... এদের দেবদাসী বলা হত।’ যে-কন্যাসন্তানের মৃত্যুকামনা করেন বাবা-মা, যাকে সাগরের জলে ভাসিয়ে দেওয়া যায়, যাকে দেবদাসী বানানো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, তাকে নিয়ে কোনো মা ঘুমপাড়ানি গান গাইবেন তা যুক্তসংগত নয়। আর তাই একটি মেয়েকে ছড়ার পঙক্তিতে মনস্তাত্ত্বিক কারণেই আনতে পারেননি পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বসবাসরত আমাদের এই ঐতিহাসিক সময়ের ছড়াকার।
আমাদের বর্তমান বাস্তবেও উক্ত পঙ্ক্তিটি কিছুটা বিনির্মাণসহ এখনও সত্য। এখনও আমরা সন্তানগর্ভে এলে অচেতনভাবে হলেও একটি ছেলেসন্তান কামনা করি। আলট্রাসোনোগ্রামে যদি দেখা যায় যে সন্তানটি কন্যা, তবে বেদনামধুর এক হাসি হেসে আমরা মৌখিকভাবে বলি, ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক, যা-ই হোক, তা নিয়ে আমরা চিন্তা করিনি।’ আর আমাদের ছেলেরা তো এখন আর ঘুমায় না, পাড়াও জুড়ায় না। আমাদের বর্তমানের ছেলেরা ব্যস্ত মাস্তানিতে, চাঁদাবাজিতে, বড় বড় গডফাদার ছেলেদের আদেশে বড় বড় কুকর্ম করাতে। আর আমাদের কন্যারা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সদস্য হয়ে হচ্ছে যৌতুকের বলি, ধর্ষণের বস্তু, সমাজ ও ভাষাসন্ত্রাসের শিকার। ফেসবুক থেকে