শিরোনাম

প্রকাশিত : ০৫ আগস্ট, ২০২৫, ০৫:০২ বিকাল
আপডেট : ০৫ আগস্ট, ২০২৫, ০৭:০০ বিকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: এক বছরে ৫ ইস্যুতে টানাপোড়েন

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বিগত এক বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে টানাপোড়েন বেড়ে চলেছে। প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে অন্তত ৫টি ইস্যুতে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে।

এসব ইস্যুর মধ্যে রয়েছে—গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত  সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা, বাণিজ্য বিধিনিষেধ, পুশ-ইন,  ভিসা বন্ধ ও সীমান্ত হত্যা।

শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার ইস্যু: ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। সে সময় ভারত সরকার দেশটির সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তাকে আশ্রয় দেয়। ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পরে বিভিন্ন সময়ে অডিও বক্তব্য দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তার এসব বক্তব্যকে উসকানিমূলক হিসেবে দেখেছে বাংলাদেশ সরকার। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে বিভিন্ন টানাপোড়েন শুরু হয়।

শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে ভারত সরকারের কাছে চিঠি পাঠালেও তার জবাব পায়নি বাংলাদেশ সরকার। এমনকি শেখ হাসিনা যেন ভারতে বসে কোনো ধরনের রাজনৈতিক বা উসকানিমূলক বক্তব্য দিতে না পারেন, সে ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানানো হলেও মোদী সরকার তা নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন চলে আসছে।

বাণিজ্য বিধিনিষেধ: অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ভারত বাংলাদেশের ওপর তিন দফা বাণিজ্য বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এসব বিধিনিষেধ আরোপের প্রেক্ষিতে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। চলতি বছর ৯ এপ্রিল কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সুবিধা প্রত্যাহার করে ভারত। ফলে বিদেশে পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ কিছুটা ক্ষতির মুখে পড়ে। এরপর দ্বিতীয় দফায় গত ১৭ মে স্থলবন্দর দিয়ে বেশ কয়েকটি পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ দেয় ভারত। সবশেষ তৃতীয় দফায় গত ২৮ জুন পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় ভারত। অবশ্য ভারতের এসব বিধিনিষেধের  প্রেক্ষিতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ।

ভিসা বন্ধ: ৫ আগস্ট বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষিতে ভারত বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য পর্যটক ভিসা বন্ধ করে দেয়। সে কারণে বাংলাদেশি কেউ আর এখন পর্যটক ভিসা নিয়ে ভারত ভ্রমণ করতে পারছেন না। তবে পর্যটক ভিসা বন্ধ থাকলেও জরুরি চিকিৎসা ও শিক্ষার্থীদের জন্য ভিসা চালু রেখেছে দেশটি। অন্যদিকে ৫ আগস্টের পর ভারতের নাগরিকদের জন্যও বাংলাদেশ ভিসা কড়াকড়ি আরোপ করেছে। ভারতে বাংলাদেশের বিভিন্ন মিশন থেকে দেশটির নাগরিকরাও সহজে ভিসা পাচ্ছেন না।

আর যেসব দেশের ভিসার জন্য বাংলাদেশিদের দিল্লি যাওয়া প্রয়োজন হতো, তার জন্য বিকল্প ব্যবস্থাও চালু করেছে বাংলাদেশ। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েনও চলছে।

ভারত থেকে পুশ-ইন: ভারত থেকে প্রতিনিয়ত পুশ-ইনের ঘটনা ঘটছে। এ নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে তীব্র টানাপোড়েন চলছে। ভারতের কাশ্মীরের পেহেলগাঁওয়ে গত ২২ এপ্রিল এক সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ ভারতীয় নাগরিক নিহত হন।

তারপরই ভারতের গুজরাটে অভিযান চালিয়ে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ দাবি করে কিছু লোককে আটক করা হয়। পরে তাদের পুশ-ইন করতে থাকে ভারত। ইতোমধ্যে প্রায় দুই  হাজার লোককে পুশ-ইন করেছে ভারত। পুশ-ইন বন্ধে ভারতকে চার দফা চিঠিও দেওয়া হয়েছে। তারপরেও পুশ-ইন বন্ধ হচ্ছে না।

বাংলাদেশে পুশ-ইন করতে ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় লোকদের প্রতিনিয়ত জড়ো করা হচ্ছে। এ নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উদ্বেগও প্রকাশ করা হয়েছে। অন্যদিকে পুশ-ইনের ঘটনায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, ভারতীয় মুসলিমদের বাংলাদেশে পুশ-ইন করা হচ্ছে।

সীমান্ত হত্যা: অতীতের মতো অন্তর্বর্তী  সরকারের আমলেও একাধিক সীমান্ত হত্যার ঘটনা ঘটেছে। তবে সীমান্ত হত্যার ঘটনায় কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা। প্রতিটি সীমান্ত হত্যার ঘটনায় ভারতের কাছে প্রতিবাদপত্র পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া  সীমান্ত হত্যার প্রতিবাদে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলবও করা হয়।

সীমান্ত হত্যার ঘটনায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, সীমান্ত হত্যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই ইস্যুতে আমরা প্রতিবাদের ভাষা খুব শক্ত করেছি।

বিপরীত চিত্র: বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নানা ইস্যুতে টানাপোড়েন চললেও ভিন্ন চিত্রও দেখা গেছে। সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় অগ্নিদগ্ধদের চিকিৎসাসেবা দিতে ভারত সরকার একটি মেডিকেল টিম পাঠিয়েছিল। মেডিকেল টিম দগ্ধদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছে। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যেই গত বছর ৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে যোগ দেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি।

অন্যদিকে চলতি বছর ৪ এপ্রিল থাইল্যান্ডে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদীর বৈঠক হয়। প্রথমে এই বৈঠক নিয়ে  অনিশ্চয়তা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা সম্পন্ন হয়। আর এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে  দুই দেশের সম্পর্কে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরেছে।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন: বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বাংলানিউজকে বলেন, আমি মনে করি ভারত এখনো  বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা অনুধাবন করতে পারছে না। এটা তাদের পররাষ্ট্রনীতির একটি দুর্বলতা। এ ছাড়া ভারত আওয়ামী লীগের ওপর ভর করে বাংলাদেশে আধিপত্য বিস্তার করতো, ভারতের সেই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, তা না হলে দুই দেশের সম্পর্কে গতি আসবে না।

বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন,   অতীতে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ছিল না। তাদের সম্পর্ক ছিল শেখ হাসিনার সঙ্গে। নয়াদিল্লিকে এখন বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার অতীতের মতো নয়। বর্তমান সরকারের সঙ্গে সে অনুযায়ীই কাজ করতে হবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক বাড়াতে হবে। তাহলে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন কমে আসবে।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা যা বলছেন: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে  বর্তমান অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা ভারতের সঙ্গে  পারস্পরিক বোঝাপড়ার ওপর ভিত্তি করে একটি সম্পর্ক চাই। আমাদের অবস্থানে কোনো অস্পষ্টতা নেই। আমাদের দুই দেশের কেন্দ্রে যে সরকারই হোক, যে দলই ক্ষমতায় থাক না কেন, তা আমাদের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলা উচিত নয়। কারণ সম্পর্ক পারস্পরিক স্বার্থ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ওপর নির্ভরশীল।

শেখ হাসিনার বিষয়ে তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। তাই বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছে তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে, যাতে তাকে বিচারের মুখোমুখি করা যায়। যতক্ষণ না ভারত সরকার তাকে ফিরিয়ে দেয়, আমরা আশা করব তারা অন্তত (হাসিনার ওপর) কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে, যাতে তিনি উসকানিমূলক ও মিথ্যা মন্তব্য না করেন, যা মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। উৎস: বাংলানিউজ২৪

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়