২০২৩ সালে দালালদের প্রলোভনে পড়ে উন্নত জীবনের আশায় সাগর ও তানজির প্রত্যেকে ৪ লাখ টাকা খরচ করে লিবিয়া যান। আর আলমগীর বিদেশ গিয়েছিলেন ৩ লাখ টাকা খরচ করে আড়াই বছর আগে। দালালরা তাদের ইতালিতে চাকরি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে লিবিয়া পাঠিয়েছিলেন। সেখানে পৌঁছানোর পর পাচারকারীরা তাদেরকে এক মাফিয়া চক্রের কাছে বিক্রি করে দেন। ত্রিপোলিতে আরও ৮০ জন বাংলাদেশির সঙ্গে আটকে রেখে তাদের ওপর চালানো হয় মাসের পর মাস নির্মম নির্যাতন। সাগর, তানজির ও আলমগীর বাংলাদেশ দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহায়তায় ৯ জুলাই সকালে দেশে ফেরেন লিবিয়ায় আটকে পড়া আরও ১৪১ জন বাংলাদেশির সঙ্গে।
৬ মাসে সাগর পাড়ি দিয়েছেন প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি
অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে স্বপ্নের ইউরোপ যেতে গিয়ে হাজার হাজার বাংলাদেশি হচ্ছেন নিঃস্ব। আবার অনেকেই ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকা ডুবে হচ্ছেন নিখোঁজ কিংবা মারা যাচ্ছেন। জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্যমতে— চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৯ হাজার ৭৩৫ জন বাংলাদেশি ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি প্রবেশের চেষ্টা করেন। এছাড়া গত ১৮ আগস্টের প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের তুলনায় সাগর পথে ইতালি প্রবেশের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম’র তথ্য বলছে, চলতি বছর এখনও পর্যন্ত ৭১৮ জন অভিবাসী কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগরে নিখোঁজ কিংবা মারা গেছেন। তাদের মধ্যে পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে ৭০১ জনের। ভূমধ্যসাগরে এমন ট্র্যাজেডির যাত্রাটি শুরু হয় মূলত লিবিয়া উপকূল থেকে। বেশিরভাগ অভিবাসী লিবিয়া থেকে কেন্দ্রীয় (সেন্ট্রাল) ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালি বা ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেন। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে যারা মৃত্যুবরণ করেন, তাদের ১২ শতাংশ বাংলাদেশি বলে জানায় আইওএম।
দালালরা ইউরোপের স্বপ্ন দেখিয়ে নিয়ে যায় লিবিয়ায়
মানবপাচারের শিকার তানজির শেখ দেশে ফিরে জানান, লিবিয়ায় আমাদেরকে দিনের পর দিন বেঁধে রাখা হতো, লোহার রড দিয়ে পেটাতো। নির্যাতনের ভিডিও আমাদের পরিবারকে পাঠিয়ে মুক্তিপণ নিয়েছে তারা। মারা গেছি ভেবে তারা আমাদের মরুভূমিতে ফেলে রেখে গিয়েছিল। কোনেও দিন যে বেঁচে দেশে ফিরতে পারবো, সেটা ভাবিনি।
সিলেটের মোশাররফ হোসেন ভাগ্য ফেরাতে বছরখানেক আগে পাড়ি জমান লিবিয়ায়। আট লাখ টাকা দিয়ে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ধরা পড়ে দুই মাস জেল খাটেন। এখন তার সম্বল বলতে শুধু দেশে ফিরে বিমানবন্দরে আইওএমের দেওয়া ৬ হাজার টাকা ও একটি কাপড়ের ব্যাগ।
বেনগাজীর গানফুদা ডিটেনশন সেন্টার থেকে গত ২১ আগস্ট দেশে ফেরা ১৭৪ জনের অভিজ্ঞতা প্রায় একই ধরনের। ইতালি যাওয়ার জন্য দালালকে কেউ দিয়েছেন ১০ লাখ, কেউবা ১৪ লাখ টাকা।
দেশে ফিরে আসা কাওসার জানান, ডিটেনশন সেন্টারে ঠিকমতো খাবার ও পানি দেয় না। দিলেও লবণ পানি খেতে হতো। এতে আমরা অসুস্থ হয়ে যেতাম। পুরো মাসে একবারও বাইরে যেতে দেওয়া হতো না। চার দেয়ালের মধ্যে একটিমাত্র রুমে বন্দি থাকতে হতো।
ইউরোপে চাকরির প্রলোভন: ৭৯ শতাংশই নির্যাতনের শিকার
গত বছর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক লিবিয়া থেকে ফেরত আসা ৫৫৭ জন বাংলাদেশির যাত্রা, গন্তব্য, অর্থ, নিপীড়ন, উদ্ধার থেকে শুরু করে প্রত্যেকের ৫০ ধরনের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানতে পারে— বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে যাদের লিবিয়া নিয়ে যাওয়া হয়, তাদের সবাইকে ভালো চাকরির প্রলোভন দেখানো হলেও তারা চাকরি পান না। উল্টো অধিকাংশকেই লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দি রেখে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। তাদেরকে জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে অর্থ। তবে এত কিছুর পরেও ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপের স্বপ্নে লিবিয়া যাওয়ার এই প্রবণতা থামছে না।
ব্র্যাকের গবেষণায় দেখা গেছে, ২৬ থেকে ৪০ বছর বয়সী লোকজন সবচেয়ে বেশি ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে ৩১ থেকে ৩৫ বছরের লোকের সংখ্যাই বেশি। এদের বেশিরভাগেরই বাড়ি মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লা এলাকায়। লিবিয়া ফেরত ৫৫৭ বাংলাদেশির তথ্য অনুযায়ী, তাদের ৬০ শতাংশের পরিবারকে স্থানীয় দালালরা ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়েছিল। কিন্তু ৮৯ শতাংশই চাকরি বা কোন কাজ পাননি। উল্টো নানা ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছেন।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এভাবে লিবিয়া যাওয়ার পথে ৬৩ শতাংশই বন্দি হয়েছেন। বন্দিদের মধ্যে ৯৩ শতাংশই ক্যাম্পে বন্দি ছিলেন। তাদের ৭৯ শতাংশই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর ৬৮ শতাংশই মুক্তভাবে চলাচলের স্বাধীনতা হারিয়েছেন। ৫৪ শতাংশই বলেছেন, তারা কখনও তিনবেলা খাবার পাননি। অন্তত ২২ শতাংশ দিনে মাত্র একবেলা খাবার পেয়েছেন।
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান (মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) বলেন, ‘বাংলাদেশের সব জেলার লোক কিন্তু এভাবে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করে না। মূলত শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকার লোকজন এভাবে ইউরোপে যান।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় এটি উঠে এসেছে— দালালরা এসব এলাকার অভিভাবক ও তরুণদের ভালো চাকরি আর ইউরোপের প্রলোভন দেখাচ্ছে, যেটি বাস্তব নয়। কাজেই সাধারণ মানুষ ও বিদেশগামীদের সবার আগে সচেতন হতে হবে। এলাকার স্থানীয় দালাল ও মানবপাচার চক্রকে চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের বিরুদ্ধে সমন্বিত অভিযান চালাতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অর্থের লেনদেন খুঁজে বের করতে হবে। পাশাপাশি যে আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী-চক্র রয়েছে লিবিয়া বা অন্য দেশে, তাদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হতে হবে আন্তর্জাতিকভাবে। পাশাপাশি লিবিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তান— এই এলাকার স্থিতিশীলতা জরুরি। নয়তো সেখানকার মানুষজন জীবন বাঁচাতে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করবে, আর সেই সুযোগে পাচারকারীরা বাংলাদেশে মতো আরও অনেক দেশের নাগরিকদের সেখানে যুক্ত করবে। কাজেই সম্মিলিতভাবে এই পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
সাত মাসে লিবিয়া থেকে ফিরেছেন ১৫৪৫
লিবিয়া গিয়ে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার ঘটনায় অনেক বাংলাদেশি গ্রেফতার হন। লিবিয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে ডিটেনশন সেন্টারে রাখে। সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস বিভিন্ন ডিটেনশন সেন্টারে আটক বাংলাদেশি নাগরিকদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। গত ৭ মাসে লিবিয়া থেকে ১ হাজার ৫৪৫ জন বাংলাদেশি নাগরিককে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই লিবিয়ার ডিটেনশন সেন্টারে আটক এবং বিপদগ্রস্ত অবস্থায় ছিলেন।
এছাড়া দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার ৭০০ জনকে লিবিয়া থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আর ২০১৯ সাল থেকে মোট ১০ হাজার ৭২৮ জনকে লিবিয়া থেকে ফেরত আনা হয়েছে।
এক পাচারকারীকেও ফেরত আনা হয়েছে
মানবপাচার চক্রের এক সক্রিয় সদস্যকে লিবিয়া থেকে ফেরত আনা হয়েছে। গত ২১ আগস্ট ফেরত আসার পর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাকে গ্রেফতার করে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গ্রেফতার ব্যক্তির নাম সাখাওয়াত হোসেন (৪২)। সিআইডি জানায়, গ্রেফতার মানবপাচারকারী সাখাওয়াত হোসেন জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ট্রাফিক হেলপার মো. শওকত আলীসহ আরও চার-পাঁচজন লিবিয়ায় মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত। তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান করছে সিআইডির মানবপাচার প্রতিরোধ ইউনিট।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান জানান, লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের দেওয়া আউটপাসে দেশে ফেরেন মোট ১৭৫ জন বাংলাদেশি। চার্টার ফ্লাইটযোগে বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) সকাল ৬টা ৩১ মিনিটে তারা ঢাকায় পৌঁছান। যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তথ্য লিপিবদ্ধ করার সময় জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সহযোগিতায় সিআইডি মানবপাচার চক্রের একজন এজাহারভুক্ত আসামিকে গ্রেফতার করে।
গ্রেফতার সাখাওয়াত হোসেন দীর্ঘদিন ধরে লিবিয়ায় মাফিয়া সিন্ডিকেট পরিচালনা ও অপহরণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে এয়ারপোর্ট থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে বিভিন্ন ধারায় মামলা রয়েছে। এছাড়া কিশোরগঞ্জ সদর থানায়ও আরেকটি মামলা আছে তার বিরুদ্ধে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাখাওয়াত হোসেন সিআইডির কাছে স্বীকার করেছেন, তিনি ৪০০ থেকে ৫০০ বাংলাদেশিকে চারটি নৌকায় করে লিবিয়া থেকে ইতালিতে অবৈধভাবে পাঠিয়েছেন। এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেন তিনি।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন খান আরও বলেন, মানবপাচার প্রতিরোধে সিআইডির বিশেষ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে গ্রেফতার আসামির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। আইনগত প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করে অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনা হবে। উৎস: বাংলাট্রিবিউন।