অনেকেই বুঝে বা না বুঝে এমন উপার্জনে জড়িয়ে পড়েন যা আল্লাহর কাছে অপবিত্র ও গ্রহণযোগ্য নয়। সময় গড়ায়, হৃদয় নরম হয়, ইমান জাগে—তখন মনে প্রশ্ন ওঠে, ‘আমি যে হারাম আয় করেছি, তার হুকুম কী? শুধু তওবা করলেই কি সব ঠিক হয়ে যাবে? নাকি এই সম্পদ দিয়ে কিছু করতে হবে?’
হারাম উপার্জন থেকে বাঁচার উপায়—
মানুষ ভুল করেই ফেলে—কখনো টাকার লোভে, কখনো পরিস্থিতির চাপে, কখনো আবার অজান্তেই। কিন্তু যখন অন্তর নরম হয়, চোখ খুলে যায়, আর হৃদয় সত্যকে চিনতে পারে—তখন অনুতাপের আগুন ভেতরটা পুড়িয়ে দেয়। সেই মুহূর্তে একজন মুমিনের প্রথম দায়িত্ব হলো—যে হারাম সম্পদ ভুলভাবে অর্জন করেছে, তা অবিলম্বে তার প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া।
কারণ যা আমার নয়, যা আমার হকের মধ্যে পড়ে না—তা কখনোই আমার জীবনের অংশ হয়ে থাকতে পারে না। যৌতুকের টাকা হোক, ঘুসের অর্থ হোক, সুদের বিনিময়ে পাওয়া আয় হোক—এসব যার কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে, তার অধিকার তাকেই ফিরিয়ে দিতে হবে। এটাই ন্যায়; এটাই তাওবার প্রথম প্রমাণ।
অনেকেই ভাবেন— ‘আমি তো তওবা করেছি, কেঁদেছি, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়েছি— তাহলে কি হারাম সম্পদ হালাল হয়ে যাবে?’ না—প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে না দিলে শুধু মুখের তওবায় হারাম কখনো হালাল হয় না। আর শুধু তওবা করলেই— হারাম সম্পদ উপার্জনের দায় ও গুনাহ থেকে মানুষ মুক্ত হয় না।
যে হারাম আয় হৃদয়ে অশান্তি ঢুকিয়েছে, যে অন্যায়ের ওপর দাঁড়িয়ে বাড়ি-গাড়ি বানানো হয়েছে— সেসব থেকে মুক্ত হওয়ার একমাত্র পথ হলো মালিককে তার হক ফিরিয়ে দেওয়া। কারণ, আল্লাহ হক নষ্টকারীদের ভালোবাসেন না, আর অন্যের হক আদায়কারীদের দরজা তিনি কখনো বন্ধ করেন না।
হারামভাবে উপার্জিত সম্পদ ফেরত দেওয়ার সুযোগ না থাকলে—
কিন্তু অনেক সময় এমন অবস্থাও আসে— যেখানে হারাম আয় যার কাছ থেকে নেওয়া হয়েছিল, তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না, তার পরিচয় হারিয়ে গেছে, অথবা কোনোভাবেই টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকে না। তখন হৃদয় আরও বেশি ভারী হয়ে ওঠে। কারণ, হাতে ধরা টাকাটা নিজের নয়— তবুও ফেরত দেওয়ার পথ বন্ধ।
এই পরিস্থিতিতে শরিয়তের নির্দেশ সুস্পষ্ট— সে হারাম সম্পদ দান করে দিতে হবে, ঠিক যেন হাতের ময়লা ঝেড়ে ফেলার মতো। তবে মনে রাখতে হবে—
> এই দান সওয়াবের জন্য নয়।
> এটি নিছক দায়িত্ব— হারাম থেকে নিজেদের পবিত্র করার একটি বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ।
কারণ যে সম্পদ নিজের নয়, যার ওপর আমার মালিকানা নেই— তার বিনিময়ে সওয়াব আশা করাও চরম ভুল। আমরা কেবল আত্মাকে পবিত্র করি, হৃদয়কে পরিষ্কার করি— এটাই উদ্দেশ্য। যেন হারামের ছায়া থেকে বের হয়ে আল্লাহর কাছে ফিরতে পারি মাথা উঁচু করে। এ দান সওয়াবের জন্য নয়— বরং গুনাহ থেকে মুক্তির পথে এক প্রয়োজনীয় আত্মশুদ্ধি। হৃদয়ের ভার নামানোর শেষ চেষ্টা।
হালাল উপার্জনের গুরুত্ব
ইসলাম উপার্জনের ক্ষেত্রে শুধু টাকা–পয়সা দেখেনি; দেখেছে তার উৎস, তার পবিত্রতা, তার হালালতা। কারণ উপার্জন শুধু জীবিকা নয়—এটি মানুষের চরিত্র, পরিবার, ভবিষ্যৎ ও আখেরাতের ভিত্তি। হালাল উপার্জন মনকে শান্ত করে, ঘরে প্রশান্তি আনে, জীবনে বরকত জমা হয়—আর হারাম উপার্জন আস্তে আস্তে নষ্ট করে দেয় সবকিছু।
যে মানুষ হালাল–হারামের তোয়াক্কা না করে আয় করে, তার টাকা হয়তো বেড়ে যায়, কিন্তু বরকত শুকিয়ে যায়। সেই সম্পদ দেখতে চকচকে হলেও ভেতরে ভেতরে পচে থাকে। এমন ব্যক্তির খাবার হয় হারাম, তার পোশাক হয় হারাম, তার দেহে বইতে থাকে হারামের রক্ত। এমনকি তার সন্তানদের দেহও সেই অপবিত্র উপার্জনে গঠিত হয়। ভাবুন—একটি নিষ্পাপ শিশুর শরীর পর্যন্ত হারাম খাবারে তৈরি!
এরপরও কি শান্তি থাকবে? থাকবে কি মুহূর্তের জন্যও স্নিগ্ধতা? থাকবে কি মনভরা তুষ্টি?
এ ধরনের জীবনের প্রতিটি ইট দাঁড়িয়ে থাকে হারামের ওপর। যে যতই সম্পদ জমাক, যতই বাড়ি–গাড়ি করুক, ভেতরটা থাকবে ফাঁপা—বরকতহীন। তার মাল বাড়লেও আল্লাহর রহমত তার জীবনের দরজায় আর কড়া নাড়ে না। হারাম আয় মানুষকে চোখে পড়ে ধনী করে, কিন্তু আল্লাহর কাছে করে দেয় দারিদ্র্যের প্রতীক।
তাই হালাল উপার্জনে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, এতে রয়েছে বরকত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
فَمَنْ أَخَذَهُ بِحَقِّهِ وَوَضَعَهُ فِي حَقِّهِ فَنِعْمَ الْمَعُونَةُ هُوَ وَمَنْ أَخَذَهُ بِغَيْرِ حَقِّهِ كَانَ كَالَّذِي يَأْكُلُ وَلاَ يَشْبَعُ
‘যে ব্যক্তি তা সৎ পন্থায় উপার্জন করল, সে সে পথেই থাকল। সে কতই না সাহায্য সহযোগিতার সুযোগ লাভ করে। আর যে ব্যক্তি তা অসৎ পন্থায় উপার্জন করল তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে- এক ব্যক্তি খাচ্ছে অথচ পরিতৃপ্ত হতে পারছে না।’ (মুসলিম ২৩১১)
হালাল রিজিক অনুসন্ধান করা আবশ্যক। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন—
طَلَبُ كَسْبِ الْحَلَالِ فَرِيضَةٌ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ
‘অন্যান্য ফরজ কাজ আদায়ের সঙ্গে হালাল রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা গ্রহণ করাও একটি ফরজ।’ (বায়হাকি ৪৬০)
হালাল পন্থায় রিজিক অনুসন্ধানে বিশেষ সওয়াব অর্জন হয়। নবীজি (সা.) বলেন—
وَلِزَوْجِهَا أَجْرُهُ بِمَا كَسَبَ
‘স্বামীর জন্য তার উপার্জনের কারণে সওয়াব রয়েছে'। (বুখারি ১৪২৫)
নিজ হাতে উপার্জন করা নবী-রাসুলদের সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন—
مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ خَيْرًا مِنْ أَنْ يَأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ وَإِنَّ نَبِيَّ اللهِ دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلاَم كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ
‘নিজ হাতে উপার্জিত খাবারের থেকে উত্তম খাবার কখনো কেউ খায় না। আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন।' (বুখারি ২০৭২)
সূত্র: যুগান্তর