রাশিদ রিয়াজ: মির্জা গালিবের জন্ম ১৭৯৭ সালে যখন ভারতবর্ষে মোঘলদের সেই আধিপত্য আর অবশিষ্ট নেই। আওরঙ্গজেবের সময় বিশ্বের ৪৫ শতাংশ মূল জিডিপি অর্জন হত মোঘলদের হাতে। একটু সৌভাগ্যের আশায় ফ্রান্স, ব্রিটেন বা ইউরোপ থেকে বণিকরা, পর্তুগিজরা ভারতে আসত একটি সৌভাগ্যের আশায়। পুরো ভারতে যখন মোঘলদের চাকচিক্যের আর অবশিষ্ট ছিল না তখন মির্জা গালিবের আগমন।
গালিব কখনো তার জীবিকার জন্য কাজ করেননি। সারা জীবনই তিনি হয় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অথবা ধার কর্য করে নতুবা কোনো বন্ধু উদারতায় জীবন যাপন করেন। এক পর্যায়ে জুয়া খেলার জন্যে মির্জা গালিবকে জেল খাটতে হয়েছিল। তবে গালিবের এর খ্যাতি আসে তার মৃত্যুর পর। মির্জা গালিব তার নিজের সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন যে, তিনি বেঁচে থাকতে তার গুণকে কেউ স্বীকৃতি না দিলেও, পরবর্তী প্রজন্ম তাকে স্বীকৃতি দিবে। ইতিহাস এর সত্যতা প্রমাণ করেছে। উর্দূ কবিদের মধ্যে তাকে নিয়েই সবচেয়ে বেশি লেখা হয়েছে। সাহিত্যে তার অনন্য অবদানের জন্য তাকে দাবির-উল-মালিক ও নাজিম-উদ-দৌলা উপাধি দেওয়া হয়। ইংরেজদের দেওয়া ২৭ টাকা মাসিক মাসোয়ারা ছিল তার একমাত্র আয়। নিজে পান করার জন্যে ফ্রান্স থেকে ওল্ডটম নামের বিখ্যাত হুইস্কি আমদানি করতেন। এতে তার ৪০ হাজার টাকা দেনা হয়ে যায় তার। অথচ সেসময় হাজার দুয়েক তিনেক টাকা হলে একটি তালুক কেনা যেত। এজন্যে আদালতে তাকে যেতে হয়েছিল। গালিব কাঠগরায় দাঁড়িয়ে শের উচ্চারণ করলেন, ‘কর্জ করে আমি মদ খেতাম, কিন্তু ঠিকই জানতাম আজকে যে ভুখা অবস্থায় যে আমি পান করছি, সেই নেশার রঙ্গীন চোখ একদিন সবার চোখে রঙ ছড়িয়ে দেবে। বিচারক এ কবিতা শুনে হাসি দিয়ে তার নিজের তহবিল থেকে মির্জা গালিবের ঋণ শোধ করে দিলেন।
আরেকবার তার এক মোহাদ্দেস বন্ধু রোজার দিন দুপুরে মির্জার বাসায় গিয়ে দেখলেন তিনি আম খাচ্ছেন ও জুয়া খেলছেন। মোহাদ্দেস ওই বন্ধু ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন রোজার সময় বড় বড় শয়তানদের বন্দী করে রাখা হয়। এখন আমি কি দেখছি। মির্জা গালিব তার বন্ধুকে রাগ করতে বারণ করে বললেন, তুমি হাদিস ঠিকই শুনেছো। বিন্দুমাত্র ভুল শোননি। শয়তানকে ঠিকই বন্দী করে রাখা হয়। তবে এই ঘরটি সেই ঘর যেখানে শয়তানকে বন্দী করে রাখা হয়েছে।
১৮৫৭ সালের সিপাহীবিদ্রোহ এর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশরা পুরোপুরিভাবে মোঘলদের ক্ষমতাচ্যুত করে সিংহাসন দখল করে, মির্জা তার লেখায় এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন। মহাবিদ্রোহের সময়কার তার লেখা সেই দিনলিপির নাম দাস্তাম্বু। তিনি জীবনকালে বেশ কয়েকটি গজল রচনা করেছিলেন যা পরবর্তীতে বিভিন্ন জন বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন ও গেয়েছেন। মির্জা গালিবকে মোঘল সাম্রাজ্যের সর্বশেষ কবি হিসেবে ও দক্ষিণ এশিয়ায় তাকে উর্দু ভাষার সবচেয়ে প্রভাবশালী কবি বলে মনে করা হয়। আজ শুধু ভারত বা পাকিস্তানে নয় সারা বিশ্বেই গালিবের জনপ্রিয়তা রয়েছে।
কেনো মির্জা গালিব কবিতা লিখতেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি তার এক ফার্সি কবিতায় বলেছিলেন, ‘আমি যখন কবিতা বলব বলে উঠে দাঁড়াই, তখন শব্দেরা ভিক্ষাপাত্র নিয়ে আমার সামনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়, কাতর স্বরে বলে আমাদের কিছু অর্থ ভিক্ষা দিন’।
আপনার মতামত লিখুন :