শিরোনাম

প্রকাশিত : ২৯ জানুয়ারী, ২০২৩, ০৯:২০ সকাল
আপডেট : ৩০ জানুয়ারী, ২০২৩, ০২:৪২ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

হতে চেয়েছিলেন ডাক্তার, হলেন বিসিএস ক্যাডার

কৌশিক সরকার

মিরাজুল আল মিশকাত, হাবিপ্রবি: ২০২২ সালের ৩০ মার্চ প্রকাশিত হয় ৪০ তম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল। এতে চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থী কৌশিক সরকার (জিৎ)। তিনি হাবিপ্রবির ২০০৯-১০ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন।

তুখোড় মেধাবী এ শিক্ষার্থী দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার বাসিন্দা পিতা বাবলু সরকার (মৃত) ও মাতা স্বপ্না সরকারের বড় সন্তান। গত ৪ঠা ডিসেম্বর কৌশিক সরকার উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা হিসাবে মৎস্য অধিদপ্তরে যোগদান করেন এবং তার বর্তমান কর্মস্থল সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায়।

তিনি কর্মজীবন শুরু করেছিলেন সোনালী ব্যাংকের ক্যাশ অফিসার পদে ও পরবর্তীতে রুপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে দুই বছর চাকুরি করেন। আজকের সাক্ষাৎকারে আমরা জানবো কৌশিক সরকারের সফলতার পিছনের গল্প। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন হাবিপ্রবি প্রতিনিধি মো. মিরাজুল আল মিশকাত।

প্রশ্ন: আপনার লেখাপড়ার জীবনের প্রথম দিকের ঘটনা জানতে চাই?

কৌশিক: আমি দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ি থানার গোলাম মোস্তফা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৬ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা সম্পন্ন করি। অতঃপর নটরডেম কলেজ থেকে ২০০৮ সালে উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা সম্পন্ন করি। উভয় পরীক্ষাতেই আমি জিপিএ ৫.০০ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। 

প্রশ্ন: কোথায় পড়ার ইচ্ছা ছিলো? স্বপ্ন পূরণ হয়েছিলো কি?

কৌশিক: প্রথমে তো ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। অনেক চেষ্টাও করেছি। সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কিন্তু অনেক পরে বুঝেছি ডাক্তারি পড়াটা আমার মত মানুষের জন্য নয়! আমি ডাক্তার হলেও খুব বাজে ডাক্তার হতাম। হয়ত মানুষ মারা ডাক্তার হতাম। তাই প্রায়ই সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাই এখন। উনি আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। তবে আমি যে বিষয়ে লেখাপড়া করেছি সে বিষয়টিও যে আমার খুব পছন্দের বিষয় ছিল এমনটাও না। তখন চিন্তা ভাবনায় অপরিপক্ক ছিলাম। তাই সিদ্ধান্ত গুলোও অপরিপক্কই হয়েছে। তবে এখন বুঝি নিজের পছন্দ বা ভালোলাগার বিষয়ে লেখাপড়া করার গুরুত্বই আলাদা। আমাকে যদি এখন আরেকবার সুযোগ দেয়া হতো, তাহলে আমি মিডিয়া এন্ড ফিল্ম মেকিং কিংবা নাটক ও নাট্যততত্ত্ব নিয়ে পড়তে চাইতাম। 

প্রশ্ন: কবে থেকে চাকরির প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলেন এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে কখন থেকে প্রস্তুতি শুরু করা উচিত বলে মনে করেন ?

কৌশিক: আমি স্নাতক ডিগ্রি শেষ করেই মূলত চাকরির লেখাপড়া শুরু করি। যদিও প্রথমে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নেব এমন পরিস্থিতি ছিল না। প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করার সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছিলাম। কিন্তু মাস্টার্স করা অবস্থায় হলে থাকা রুমমেট, বন্ধু- বান্ধবদের প্ররোচনা ও উস্কানিতে মূলত ৩৬তম বিসিএস পরীক্ষা দিতে গিয়েই নিয়তির নির্মম পরিহাসে আমি চাকরির লেখাপড়ার সাথে জড়িয়ে গেলাম, বলা যায় ফেঁসে গেলাম। নির্মম পরিহাস বললাম একারণে যে, এই চাকরির পাওয়ার পথে হাঁটতে গিয়ে পরবর্তী চার-পাঁচ বছর ধরে যে কি পরিমান মানসিক যন্ত্রণা, কষ্ট, ব্যর্থতা, হতাশা, লড়াই, সংগ্রাম, অপেক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তা আমার সৃষ্টিকর্তা জানেন। সবাই তো সফলদের সফলতা দেখে, কেউ যদি তার পেছনের সংগ্রাম গুলোকে দেখত তাহলে ব্যর্থতার, দুঃখ, কষ্টের এক করুন ইতিহাস খুঁজে পেত। তাহলে সফলতাটিকে উপলব্ধি করতে পারত সবাই। তখন সকলে বুঝত সফলতা জিনিসটা রাতারাতি আসে না কিংবা শুধুমাত্র ভাগ্যের বিষয় নয়।

বর্তমান প্রক্ষাপট হোক কিংবা আরো দশ বছর পরেই হোক, স্নাতক ডিগ্রি শেষ করার আগে চাকরির প্রস্ততিতে প্রবেশ করাকে আমি সমর্থন করি না। প্রতিটি জিনিসেরই একটি সময় থাকে। যেটা যে সময়ে দরকার সে সময়েই করা উচিৎ। স্নাতকের সময়টাতে তারপরও কেউ যদি চাকরির ব্যাপারে কিছু করতেই চায় তাহলে বলব শুধু মাত্র ইংরেজি আর গনিতের ব্যাসিকটা যেন ঠিক করে নেয়। বরং এসময়ে সবার বিভিন্ন স্কিল বাড়ানোতে মনোযোগ দেয়া উচিৎ। সেটা হতে পারে ইংলিশ স্পিকিং, ফ্রি হ্যান্ড রাইটিং এ দক্ষতা, আইসিটির বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা বাড়ানো কিংবা বিভিন্ন সংগঠনে যোগ দিয়ে নেতৃত্ব গুণ বাড়ানো কিংবা নিজের মধ্যে সৃজনশীলতা বাড়ানো। 

প্রশ্ন: একাডেমিক রেজাল্ট কেমন প্রভাব ফেলে জব সেক্টরে ? 

কৌশিক: আমার নিজের একাডেমিক রেজাল্ট মোটেই ভালো না। কিন্তু নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি জীবনে কোন কিছুই একবারে গুরুত্বহীন নয়, খেলনা নয়। খারাপ একাডেমিক রেজাল্ট হয়ত বাংলাদেশের বেশিরভাগ চাকরি পাবার পথে কোন বাঁধা তৈরি করবে না, তবে চাকরি পাওয়াটাই তো সব নয়, এরপরেও অনেক কিছু থাকে। কোথাও না কোথাও আটকে যেতেই হবে। কোন না কোন ভালো সুযোগ হাত ছাড়া হয়ে যাবেই। তাই একাডেমিক রেজাল্ট ভালো রাখলে সেটা কখনোই গুরুত্বহীন নয়। বরং ক্ষেত্র বিশেষে আপনাকে জিতিয়ে দেবে।

প্রশ্ন: দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে ৪০ তম বিসিএস এর ফলাফল পেতে, বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?

কৌশিক: ৪০ এর ফলাফল দেরি হওয়াতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৪০ এর নিয়োগপ্রাপ্তরাই হয়েছে। জীবন থেকে দুই-তিন বছর ঝরে গেছে। আর এতে অনেকেই অনেক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। করোনার আঘাত ৪০তম বিসিএস এর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে। নন ক্যাডারে যারা আছেন তাদের কথা ভাবলেই নিদারুণ ভয়ে আঁতকে উঠি। কেননা আমিও তাদের একজন হতে পারতাম। এখন আমার অনেক প্রিয় মানুষজন নন-ক্যাডারে আছেন। অথচ তাদের সুদীর্ঘ প্রতিক্ষার পরেও আজ আন্দোলন করতে হচ্ছে চাকরির জন্য। অথচ তাদের অনেকের বয়স শেষ। ৪০মত বিসিএসই হয়ত তাদের শেষ ভরসা ছিল। এর মত মানসিক যন্ত্রণা আর হয় না। 

প্রশ্ন: অনুজদের প্রতি আহ্বান কি থাকবে? এবং প্রস্তুতি কিভাবে নিলে চাকরি পাওয়া সহজ হবে বলে মনে করেন?

কৌশিক: আমার অনুজ যারা আছে তারা এখন অনেক আপডেটেড। তারা অনেক কিছুতেই অনেক এগিয়ে। তাদের আমার উপদেশ খুব একটা দরকার হবে বলে মনে হয় না। তারপরও আমাকে যেহেতু বলতে বলা হয়েছে তাই অনুরোধের ঢেঁকি গিলে তাদের উদ্দেশ্যে বলব- নিজেকে আগে প্রশ্ন কর? তুমি আসলেই কি হতে চাও?কোনটা তোমার জন্য জরুরি? কোনটার জন্য তুমি সর্বোচ্চ ডেডিকেশন দিতে পারবে? দাঁতে দাঁত চেপে লেগে থাকতে পারবে? আনন্দের সাথে করতে পারবে? 

আজ কোন এক ভাই ক্যাডার হইছে বলেই তোমাকেও ক্যাডার হতে হবে এমন হঠকারি সিদ্ধান্ত নেয়া যেমন উচিৎ নয়। তেমনি কেউ একজন অনেক লেখাপড়া করেও ক্যাডার হতে পরেনি বলে তুমিও ক্যাডার হতে পারবে না বিষয়টা এমনও না। তবে যেটা হইতে চাও সেটা আদতেই হতে চাও কিনা সেটা জানাই জরুরি। তাহলে পথিমধ্যে বারবার ব্যর্থতা আসলেও হতাশা আসবে না। আর তা যদি না হয় তাহলে ফ্রাস্ট্রেশন, ডিপ্রেশন এগুলো অবশ্যম্ভাবী। 

জব পাবার ক্ষেত্র অবশ্যই পরিশ্রমের পাশাপাশি স্ট্রাটেজিক হতে হবে। সারাদিন সারারাত গাঁধার মত পড়লেও যে চাকরি হয় না, এরকম উদাহরণ প্রচুর। নিজের স্ট্রেন্থ ও উইকনেস জানাতে হবে, সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে হবে। স্বপ্ন বড় দেখতে হবে। রেগুলারিটি মেইনটেইন করতে হবে। তাহলেই চাকরি পাবার পথ সহজ হবে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে নিজ যোগ্যতা দিয়ে চাকরি পাবার কোন শর্টকাট রাস্তা নেই।

প্রশ্ন: চাকরির জন্য আপনি কিভাবে প্রস্ততি নিয়েছেন? এবং কিভাবে সময়কে ব্যবহার করেছেন?

কৌশিক: এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন আমার জন্য। কেননা আমি বিসিএস দিয়ে শুরু করে বিসিএস বাদ দিয়ে মাঝে দীর্ঘদিন ব্যাংকের প্রস্তুতি নিয়ে আবার ব্যাংক বাদ দিয়ে আবার বিসিএস দিয়ে শেষ করেছি। আর ব্যাংক বিসিএস দুই ক্ষেত্রেই সফলতা পেয়েছি। তারপরও বলছি- আমি নিজের স্ট্রেন্থ ও উইকনেস নিয়ে কাজ করেছি। দুর্বল জায়গা গুলোকে শক্তিশালী করতে যা যা করার দরকার হয়েছে, করেছি। কিছুদিন পর পর নিজেকে ইভালুয়েট করতাম। কোথায় সমস্যা আছে? কেন পরীক্ষায় টিকতেছি না? কেন একই ভুল বারবার হচ্ছে? এসব নিয়ে ভাবতাম। সমাধান খুঁজতাম সে অনুযায়ী স্ট্রাটেজি চেঞ্জ করতাম। এরকম একটি ঘটনা বলা যায়, পরপর আটটি রিটেন ফেল করার পর, পরীক্ষার হলে শুধু একটা বিষয়ে পরিবর্তন আনার পর থেকে আর কখনোই রিটেন ফেল করিনি আমি। বিষয়গুলো এরকমই। আমি পরীক্ষা কখনোই মিস দিতাম না। মাত্র ০১ টা পদের জন্যও আমি পরীক্ষা দিতে গেছি। আবার এমন অনেক পরীক্ষা দিয়েছি, যেগুলোর কোন প্রস্তুতি আমার ছিল না, তারপরও দিয়েছি। 

পরীক্ষার হলে টাইম ম্যানেজমেন্ট টা পার্সন টু পার্সন ভ্যারি করে। তাই এটা বোঝানো এই স্বল্প পরিসরে অনেক কঠিন। তবে টাইম ম্যানেজমেন্ট এর গুরুত্ব অনেক,তেমনি পরীক্ষার হলে সব প্রশ্নের উত্তর করতে পারার গুরুত্বও অনেক।

প্রশ্ন: বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সংগঠন গুলোর ভূমিকাকে কিভাবে মূল্যয়ন করবেন? 

কৌশিক: একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ হচ্ছে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠন গুলো। সংগঠন গুলো আমার শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করে। আধুনিক ও গতিশীল পৃথিবীতে শুধুমাত্র একাডেমিক রেজাল্ট কাউকে এগিয়ে দিতে পারে না। বরং একাডেমিক রেজাল্ট এর পাশাপাশি নেটওয়ার্কিং, কমিউনিকেশন, ইন্টারপার্সোনাল কমিউনিকেশন, কালচারাল মিক্সিং, ভাষাগত দক্ষতা তৈরি, পাবলিক স্পিকিং, নেতৃত্ব তৈরি, ক্রিটিকাল থিংকিং ও থট প্রসেসিং, অ্যাডাপ্টিভিটি এই দক্ষতা গুলো বাড়াতে বিভিন্ন সংগঠন গুলো রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এছাড়াও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠন ও সামাজিক দায়বদ্ধতা তৈরিতে সংগঠন গুলো কাজ করে থাকে। তাই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শিক্ষার্থীদের সংগঠন করার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার কারার মত কোন কারণ নেই। আমি নিজেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অর্ক’ নামক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম।

প্রশ্ন: আপনার মূল্যবান সময় আমাদেরকে দেয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

কৌশিক: আপনাকেও ধন্যবাদ।

প্রতিনিধি/এনএইচ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়