‘চীনকে চিনতে চীনে যেতে হবে। চীনে না গিয়ে দেশটি সম্পর্কে জানা কিছুটা কঠিন।’ সম্প্রতি চীন সফর করে আসা ঢাকার এক সাংবাদিক এভাবেই নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। তিনি জানালেন, ‘বাংলাদেশি মুসলমানরা চীন সফরের কথা শুনলে খাবার নিয়ে টেনশনে থাকে। কিন্তু চীনে গিয়ে দেখলাম মোড়ে মোড়ে হালাল খাবারের দোকান। শুধু নিজেকে মুসলিম পরিচয় দিলেই হলো। রেস্তোরাঁয় হালাল খাবারের বাইরে কিছু খেতে গেলে দেখা যাবে ওরা ছুটে এসে আপনাকে বলবে, ওটা হালাল নয়। আমার সঙ্গেই এমনটা ঘটেছে। এতই উষ্ণ তাদের আতিথেয়তা!’
চীন ঘুরে আসা বাংলাদেশি সাংবাদিকের অভিজ্ঞতার সঙ্গে চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের একটি বাণীর মিল পাওয়া যায়। তিনি বলেছিলেন, ‘যেখানেই তুমি যাও, হৃদয়ের পূর্ণতা নিয়ে যাও’। আর ভ্রমণের ক্ষেত্রে তো কথাটা আরও যুতসই। কারণ কেউ যদি নিজের আগ্রহ থেকে কোথাও না যায়, তাহলে ওই স্থান ও সেখানকার মানুষজন তার ভালো নাও লাগতে পারে।
হয়তো বাংলাদেশিদের চীন ভ্রমণের ক্ষেত্রে রয়ে গেছে ‘এই হৃদয়ের পূর্ণতা নিয়ে যাওয়ার’ ঘাটতি। তা না হলে চীন ভ্রমণকারী বাংলাদেশির সংখ্যাটা আরও বেশি হতো। দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক ও যোগাযোগ নতুন নয়, বহু পুরনো। দূরত্বও যে খুব বেশি তাও নয়।
চলতি বছর বাংলাদেশ ও চীনের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন হচ্ছে। এই অর্ধশতাব্দীতে বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম সহযোগীতে পরিণত হয়েছে চীন। বাংলাদেশ ও চীনের কূটনৈতিক সম্পর্ককে অনেকে টাইগার-ড্রাগন সম্পর্ক বলেও অভিহিত করেন। বাংলাদেশের উন্নয়নে বিভিন্ন খাতে চীনের অবদান, সম্ভাবনা, সহযোগিতা আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু পর্যটনের সম্ভাবনা নজর কাড়ছে কম। নিছক পর্যটন নয়, শিক্ষা-পর্যটন ও স্বাস্থ্য-পর্যটনেও বাংলাদেশিদের জন্য নতুন ও আকর্ষণীয় গন্তব্য হতে পারে চীন।
সম্প্রতি চীন সফর করে আসা বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম তার অভিজ্ঞতা বর্ণনায় বলেছিলেন, আমরা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের বলেছি যে তোমাদের বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল হচ্ছে, পশ্চিমাদের চোখে আমরা তোমাদের দেখি। যার ফলে আমরা মনে করতাম বেইজিং খুবই নোংরা, যানজট আর ধুলোবালিতে অচল। পশ্চিমারা এভাবেই দেখায়। কিন্তু বেইজিং ঘুরে আমি দেখেছি। তিন-চারদিন ছিলাম। শহরটি যথেষ্ট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। রাস্তায় এক টুকরো ময়লা নেই। কোটি মানুষের বসবাস, কিন্তু যানজট নেই। রাতের বেলায় সহজে চলাফেরা করা যাচ্ছে। চীন যাওয়ার আগে দেশটি নিয়ে যা কল্পনা করতাম, বাস্তব চিত্র পুরোই ভিন্ন।
নতুন গন্তব্য চীন
১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা-বেইজিং কূটনৈতিক সম্পর্কের শুরু হয়। চলতি বছর সেই সম্পর্কের পাঁচ দশক পূর্তি হলো।
বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক খাতে সম্পর্ক যথেষ্ট দৃঢ় হলেও, ভ্রমণের বিষয়ে দেশটি এখনও বাংলাদেশিদের অগ্রাধিকারে আসতে পারেনি। অথচ চিকিৎসা, শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা, বেড়ানোর জন্য বাংলাদেশিদের জন্য চীনে রয়েছে অবারিত সুযোগ। এমনকি, চীনা সরকারও বাংলাদেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিনিময়ে আগ্রহী। এতে শুধু পর্যটন নয়, শিক্ষা-পর্যটন ও মেডিক্যাল টুরিজম বাংলাদেশিদের জন্য নতুন গন্তব্য হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
গবেষণা ও চিকিৎসা খাতে চীন অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করছে। তাছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চিকিৎসা পর্যটন একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক শিল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। উন্নত চিকিৎসা সুবিধা, অত্যন্ত দক্ষ চিকিৎসা, পেশাদার এবং বিস্তৃত পরিসরের বিশেষায়িত চিকিৎসার সুবিধাসহ চীন বিশ্বজুড়ে রোগীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের জন্য, এই সহযোগিতা তার নাগরিকদের অত্যাধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি এবং দক্ষতার সুযোগ করে দেয়, যা হয়তো দেশে এত সহজলভ্য নয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সরকারি চীন সফরের সময় কুনমিংয়ের কয়েকটি হাসপাতালে বাংলাদেশিদের চিকিৎসার অনুরোধ জানান। চীনা সরকার দ্রুত এই অনুরোধে সাড়া দিয়ে ইউনান প্রদেশের ফার্স্ট পিপলস হসপিটাল, কুনমিং মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট অ্যাফিলিয়েটেড হসপিটাল এবং চাইনিজ অ্যাকাডেমি অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস-এর ফুয়াই ইউনান হসপিটালসহ মোট চারটি হাসপাতালকে বাংলাদেশিদের চিকিৎসার দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়।
চীনা সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, এসব হাসপাতালে বাংলাদেশিদের চীনা নাগরিকদের মতোই চিকিৎসা দেওয়া হবে।
সম্প্রতি চিকিৎসাসেবা নিতে চীন গিয়েছিলেন বাংলাদেশের সংগীতশিল্পী হায়দার হোসেন। নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, চীনের টেকনিক্যাল সাপোর্ট অনেক অ্যাডভান্সড। আতিথেয়তাও অনেক সুন্দর। চিকিৎসা প্রত্যাশীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো, সেবা প্রদানকারীরা তাদের কতটা আপন করে নিচ্ছে, এর কোনও অভাব আমার চোখে পড়েনি।
হায়দার আরও বলেছেন, তারা অহেতুক ওষুধ দেয় না, এটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। প্রযুক্তি তো সবার থাকে। কিন্তু যন্ত্রচালকের দক্ষতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তারা সাধারণ এক আলট্রাসনোগ্রাম দিয়ে আমার হার্টের একটা ভেইনের ইস্যু এত সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়, আমি খুবই অবাক হয়েছি।
খরচের দিক থেকেও চীন অনেক ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী বলে মন্তব্য করেছেন এই সংগীতশিল্পী।
হায়দারের মন্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন সাংবাদিক নাইম আবির। চীনের চিকিৎসাসেবা পরিদর্শনে সরকারি উদ্যোগের অংশ হিসেবে সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ থেকে যাওয়া প্রতিনিধিদলের সদস্য ছিলেন। তার মতে, চিকিৎসা খরচে স্থানীয় ও বিদেশিদের কোনও পার্থক্য করা হয় না। স্থানীয়দের চিকিৎসা নিতে যে ব্যয় করতে হয়, বাংলাদেশিদের কাছ থেকে তার বাড়তি কোনও অর্থ চার্জ করা হয় না। এছাড়া, স্বাস্থ্যবিমার কারণে চীনাদের চিকিৎসা খরচ আরও কমে যায়। যদিও বাংলাদেশি চিকিৎসা প্রত্যাশীদের জন্য এই সুবিধা এখনও চালু করা হয়নি, তবে এ নিয়ে কাজ চলছে বলে আশ্বস্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভিসাপ্রাপ্তির বিষয়ে আবির বলেছেন, চীনা কর্মকর্তারা আশ্বস্ত করেছেন, ভিসা প্রক্রিয়া যথাসম্ভব সহজ করার চেষ্টা করা হবে। ভিসা প্রাপ্তি যত সহজ হবে, সহযোগিতা তত গভীর হবে।
চীনে বাংলাদেশিদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সম্প্রতি চীন সফর করা ড. মুহাম্মদ রাশেদুল হাসান বলেছেন, চিকিৎসা প্রাপ্তি আরও সহজ করতে চীনা দূতাবাসে কিছু প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন তারা। এসবের মধ্যে ছিল চিকিৎসা প্রত্যাশীদের জন্য ভিসা ফি কমানো, দেশে বসেই অনলাইনে একটা প্রাথমিক কনসাল্টেশন, তিন থেকে চারদিনে মেডিক্যাল ভিসা ইস্যুকরণ, প্রতি রোগীর সঙ্গে অন্তত দুটি অ্যাটেনড্যান্ট ভিসা প্রদান, চীনে অবতরণের পর ইন্টারন্যাশনাল হেল্প ডেস্ক, এয়ারপোর্ট পিকআপ, মেডিক্যাল রিপোর্টে মান্দারিনের পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় লেখা ইত্যাদি।
বিশ্বের সেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫টিই রয়েছে চীনে। ফলে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য সেটি হতে পারে শিক্ষার্থী ও কাজ প্রত্যাশীদের অন্যতম গন্তব্য। গত কয়েক বছর থেকে চীনে অধ্যয়নে আগ্রহ বাড়ছে বাংলাদেশিদের। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন প্রায় ৩০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী চীনে অধ্যয়ন করছেন। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ কিছু স্কলারশিপের ব্যবস্থা রয়েছে। এসব স্কলারশিপে বিনামূল্যে পড়াশোনা ও আবাসনের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশি স্টুডেন্টস কমিউনিটি ইন চায়না গ্রুপের এক সদস্য এবং শংচিং জিয়াতং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লিমন আহমেদের মতে, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য চীন থেকে সিএসসি’র মতো কিছু বিশেষ বৃত্তি প্রদান করা হয়। টিউশন ফি ও আনুষঙ্গিক খরচ মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকেও ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কম। এছাড়া, দেশটিতে দৈনন্দিন জীবনে ইংরেজির তেমন চল না থাকলেও উচ্চশিক্ষায় ইংরেজি মাধ্যমে বহু বিষয়ে পড়ানো হয়। তবে, মান্দারিন শিখে নিলে দৈনন্দিন জীবনে এবং ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারে সুবিধা পাওয়া যাবে। ভাষা শেখার সুযোগ কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানেই পাওয়া যাবে। পড়াশোনা শেষে চীনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে, আলিবাবা, টেনসেন্ট ইত্যাদিতে ইন্টার্নশিপ বা চাকরির সুযোগও রয়েছে।
এ বিষয়ে আরেকটু বিস্তারিত মন্তব্য করেছেন বিদেশে উচ্চশিক্ষা বিষয়ক পরামর্শ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এডুমিগের সিনিয়র কাউন্সেলর এমডি স্বাধীন। তিনি বলেন, চীনে উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তির সুবিধা অনেক বেশি। এখানে ১০০ শতাংশ বৃত্তি পাওয়ার সুযোগ ইউরোপের তুলনায় যেমন বেশি, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের আবাসন ও খাবার খরচও বিভিন্ন ওয়েভারের আওতায় পড়ে যায়। সেক্ষেত্রে প্রায় বিনা খরচে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান উচ্চশিক্ষা প্রত্যাশীরা। আবার, চীন কিন্তু গবেষণা খাতে অনেক বেশি বিনিয়োগ এবং সুযোগ সুবিধা প্রদান করে। তাই উচ্চশিক্ষা যাদের ধ্যানজ্ঞান, চীন তাদের জন্য অসাধারণ এক গন্তব্য হতে পারে।
জানা গেছে, বাংলাদেশে মান্দারিন ভাষা নিয়ে ইতোমধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট মান্দারিন ভাষা শেখাচ্ছে। শান্ত মরিয়ম হোংহো কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটও আছে ভাষা শেখানোর জন্য। আরও কিছু ব্যক্তি উদ্যোগে ভাষা শেখানো হচ্ছে। এছাড়া চীনের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়েও বাংলা শেখানো হচ্ছে।
ভাষাগত ও খাবারের ইস্যু থাকলেও ইতিহাস-প্রকৃতি-সংস্কৃতি নিয়ে উৎসুক, রোমাঞ্চপ্রিয়, এমনকি রোমান্টিক থেকে শুরু করে অলস অবকাশযাপনে আগ্রহী পর্যটকদের জন্য চীন প্রায় সোনার খনি। হুনান প্রদেশে রয়েছে চাংচিয়াচিয়ে পর্বতমালা, যার অনুপ্রেরণাতেই অ্যাভাটার চলচ্চিত্রে নাআ’ভিদের বাসস্থানের চিত্র এঁকেছিলেন জেমস ক্যামেরন। রয়েছে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত অপার্থিব সুন্দর জলরাশি (ওয়াটারস্কেপ) চিউ চাই কৌ। আরও আছে তেলরঙে আঁকা ছবির মতো কুইলিন লি নদী, পাহাড়ের ঢালে মানবসৃষ্ট ড্র্যাগন লাইন টেরেস, চূড়ায় বুদ্ধের পবিত্র মন্দিরসহ মাউন্ট এমেই, থ্রি গর্জেস রিভার, কুনমিং স্টোন ফরেস্ট, ঐতিহাসিক স্থাপনা চীনের মহাপ্রাচীরসহ শত শত কাঠামো।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন