শিরোনাম
◈ বাংলাদেশে অ-রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীকে কাজ করতে দেওয়া হবে না: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ◈ ৪৮ ঘণ্টায় বঙ্গোপসাগরে নতুন লঘুচাপ সৃষ্টির সম্ভাবনা, ভারী বর্ষণের শঙ্কা ◈ খেলতে গিয়ে নদীতে ডুবে তিন শিশুর মৃত্যু, চলছে নিখোঁজ দুইজনের উদ্ধারকাজ ◈ শনিবার বিদ্যুৎ থাকবে না যেসব এলাকায় ◈ তুরস্কে ১,৬০০ বছরের প্রাচীন ওয়াইন তৈরির কারখানা উদ্ধার! ◈ ভারতের ৩৯% অবিবাহিত মনে করেন বিয়ে আর জীবনের মাইলফলক নয়, এটি ঐচ্ছিক ◈ বাংলাদেশে চতুর্থ গণভোটের আলোচনা: সংবিধানে কী আছে, আগের অভিজ্ঞতা কী বলছে ◈ বাংলাদেশকে হোয়াইটওয়াশ কর‌লো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ◈ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও কেন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হলো না?  ◈ নূর ভাই বেঁচে আছেন, সে বেঁচে থাকা মৃত‍্যুর চেয়ে একটু ভালো: অভিনেতা আফজাল হোসেন

প্রকাশিত : ৩০ অক্টোবর, ২০২৫, ০৯:৫৪ সকাল
আপডেট : ০১ নভেম্বর, ২০২৫, ১০:০০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

একটি দ্বীপের মালিকানা বিতর্কে ভারতে বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তেজনা

ছোট্ট একটি নির্জন দ্বীপ। ১৪ শতকে একটি আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের পর গঠিত হয়েছিল দ্বীপটি।  দ্বীপটির নাম কচ্ছতিভু। শ্রীলঙ্কার নেদুনতিভু এবং ভারতের রামেশ্বরমের মধ্যে পক প্রণালীতে অবস্থিত ১৬৩ একরের কচ্ছতিভু দ্বীপটি। ভারতের উপকূল থেকে প্রায় ৩৩ কিলোমিটার দূরে রামেশ্বরমের উত্তর-পূর্বে এবং শ্রীলঙ্কার জাফনা থেকে প্রায় ৬২ কি.মি দূরে এই দ্বীপের অবস্থান। এই দ্বীপে কোনো স্থায়ী বসতি নেই। তবে দ্বীপটিতে সেন্ট অ্যান্থনির নামাঙ্কিত একটি গির্জা রয়েছে। সেখানে প্রতিবছর তিন দিনব্যাপী উৎসবও হয়। দুই দেশের মানুষ সেই উৎসবে যোগও দেন। 

শ্রীলঙ্কার জাফনার তামিল এবং ভারতের তামিলনাডুর তামিল মৎস্যজীবীদের কাছে এই দ্বীপটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উভয় দেশের মৎস্যজীবীরাই মাছ ধরার জন্য এই দ্বীপ ব্যবহার করেন। কচ্ছতিভু দ্বীপের আশপাশের সমুদ্র এলাকার উপর নির্ভরশীল মৎস্যজীবীরা।  কিন্তু এখন আর তা ব্যবহার করতে পারেন না মৎস্যজীবীরা। এখান থেকেই যত ক্ষোভের জন্ম। তবে এই দ্বীপের মালিকানা নিয়ে ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে বিরোধের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বীপের মালিকানা বিতর্ক। আর এই বিতর্ক দক্ষিণ ভারতে নির্বাচনের মুখে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। গত বছরে এই বিতর্কে যোগ দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। 

ভারত ও শ্রীলঙ্কা উভয়ই ঐতিহাসিকভাবে এই দ্বীপের উপর তাদের অধিকার দাবি করেছে। বারে বারে হাতবদল হয়েছে দ্বীপটির। ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে জানা যায় যে, পর্তুগিজ, ডাচ্‌ এবং বৃটিশদের যুগ থেকেই কচ্ছতিভু দ্বীপ শ্রীলঙ্কার অধীনে ছিল। মধ্যযুগীয় সময়ে পাম্বান দ্বীপের সঙ্গে এই দ্বীপটি জাফনা রাজ্যের দখলে ছিল। ১৭ শতক থেকে দ্বীপটি ভারতের মাদুরাই (মাদুরা) জেলা বা অঞ্চলে বিদ্যমান রামনাদ রাজ্যের অংশ ছিল। পরবর্তীতে ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশ শাসনের সঙ্গে সঙ্গে দ্বীপটি মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অংশ হয়ে ওঠে। কিন্তু ১৯২১ সালে উভয় পক্ষই একটি সীমানা নির্ধারণে সম্মত হয়েছিল যা দ্বীপটিকে সিলোনিজ (শ্রীলঙ্কার আগের নাম) ভূখণ্ডের মধ্যে রেখেছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এই দ্বীপ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। 

স্বাধীনতা লাভের পরই কচ্ছতিভু দ্বীপ নিয়ে নিজেদের দাবি জানাতে শুরু করেছিল শ্রীলঙ্কা। ১৯৫৫ সালে তৎকালীন সিলন বায়ুসেনা মহড়া চালিয়েছিল কচ্ছতিভু দ্বীপে। কচ্ছতিভুর মালিকানা নিয়ে শ্রীলঙ্কার দাবির ফলে দুই দেশ বিতর্কে জড়ালেও ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ১৯৬১ সালের ১০ই মে কচ্ছতিভু দ্বীপের বিষয়টি তুচ্ছ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই ছোট্ট দ্বীপের ক্ষেত্রে কোনোরকম গুরুত্ব দেখতে পাচ্ছি না আমি। সেই দ্বীপের ওপর ভারতের দাবি তুলে নিতে কোনো আপত্তি থাকবে না আমার। বন্ধুত্ব বজায় রাখতে জওহরলাল নেহরু মৌখিক ভাবে শ্রীলঙ্কাকে কচ্ছতিভু দ্বীপে সে দেশের মৎস্যজীবীদের আসার এবং মাছ ধরার অধিকারও দিয়েছিলেন। 

শ্রীলঙ্কার ধারাবাহিক দ্বীপের মালিকানা দাবি করার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬০ সালে ভারতের তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম সি শিতলবাদ জানিয়েছিলেন, কচ্ছতিভু দ্বীপের বিষয়টি নিয়ে দিনের আলোর মতো স্বচ্ছতা না থাকলেও ওই দ্বীপের উপর ভারতের বেশি অধিকার আছে। ভারতের হাতেই কচ্ছতিভু দ্বীপ রাখার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন তিনি। অন্যদিকে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের তৎকালীন যুগ্মসচিব কে কৃষ্ণ রাও জানিয়েছিলেন, কচ্ছতিভু দ্বীপ নিয়ে শ্রীলঙ্কা যে দাবি করছে, সেটার মজবুত ভিত্তি আছে। কিন্তু সেটার মানে এই নয় যে, ভারতের কোনো দাবি নেই।

তবে ১৯৭৪ সালে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী সিরিমাভো বন্দর নায়েকের অনুরোধে কচ্ছতিভু ভারতের  তৎকালীন  প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কচ্ছতিভু শ্রীলঙ্কাকে একটি চুক্তির মাধ্যমে হস্তান্তর করে দিয়েছিলেন। 

এই চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ভারতীয় মৎস্যজীবীরা কচ্ছতিভু দ্বীপে বিশ্রাম নিতে, জাল শুকাতে এবং সেন্ট অ্যান্থনির বার্ষিক উৎসবে অংশ নিতে পারবে। কিন্তু ১৯৭৬ সালের আরেকটি চুক্তিতে মৎস্যজীবীদের বিতর্কিত জলসীমায় মাছ ধরার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। কচ্ছতিভু দ্বীপ যেহেতু তামিলনাড়ুর জেলেদের জীবিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তাই শ্রীলঙ্কার কাছে এই দ্বীপ হস্তান্তরের বিরুদ্ধে তামিলনাড়ুতে বহু আন্দোলনও হয়েছে। তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক পরিস্থিতি এই ইস্যুতে বারে বারে অস্থির হয়ে উঠেছে। কংগ্রেস-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি ছিল, কচ্ছতিভু দ্বীপে ভারতীয় মৎস্যজীবীদের দীর্ঘ দিনের মাছ ধরার অধিকার লঙ্ঘন করেছে ওই চুক্তি। তাই দ্বীপটি পুনরুদ্ধার এবং তার উপর আবার ভারতের শাসন বহাল করার দাবি জানানো হয়েছে। তামিলনাডুর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা এবং বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনও ভারত সরকারকে একাধিকবার চিঠি দিয়ে দ্বীপটি ফেরত নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। সমপ্রতি তামিলনাডু বিধানসভায় এ ব্যাপারে একটি প্রস্তাবও পাস করা হয়েছে।

আসলে শ্রীলঙ্কায় বন্দরনায়েক সরকারের পতনের পর থেকে  শ্রীলঙ্কার নতুন সরকার রামেশ্বরম, পুদুকোট্টাই এবং নগপত্তিনমের মতো এলাকার ভারতীয় মৎস্যজীবীদের কচ্ছতিভু দ্বীপের আশপাশে গেলেই নির্যাতন, হামলা ও হত্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।  

গত বছর লোকসভা নির্বাচনের আগে একটি আরটিআই সূত্রে যে সব তথ্য পাওয়া গিয়েছে তা নতুন করে বিতর্কে ইন্ধন দিয়েছে। আর এটিকে ইস্যু করে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাজনৈতিক যুদ্ধ শুরু করেছেন। কংগ্রেসকে সরাসরি আক্রমণ করে মোদি বলেছেন, তৎকালীন কংগ্রেস সরকার নির্মমভাবে দ্বীপটি শ্রীলঙ্কার হাতে তুলে দিয়েছে। মোদি কংগ্রেস ও ডিএমকে উভয়কে এই দ্বীপ হস্তান্তরের জন্য দায়ী করেছেন। তবে বিরোধীরা পাল্টা প্রশ্ন তোলেন, বিজেপি সরকার গত ১০ বছরে দ্বীপটি ফিরিয়ে আনতে কী করেছে? অবশ্য ১৯৭৪ সালের চুক্তির বৈধতা নিয়ে ভারতের শীর্ষ আদালতে একটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, চুক্তিটি ভারতের সংসদে অনুমোদিত হয় নি। এমনকি হস্তান্তরের আগে তামিলনাডু সরকারের সঙ্গেও আলোচনা করা হয় নি। 

সমপ্রতি শ্রীলঙ্কার নতুন প্রধানমন্ত্রী হরিণী অমরাসুরিয়া তার প্রথম ভারত সফরে কচ্ছতিভু নিয়ে কোনো  প্রকাশ্য বিবৃতি দেননি ঠিকই; তবে তিনি ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে  বৈঠকে কচ্ছতিভু এবং পক প্রণালীর বিষয়গুলো মৎস্য ও আঞ্চলিক সমপ্রীতির বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে আলোচনা করেছেন। কিছুদিন আগেই শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট দ্বীপটিতে সফর করেছেন। এর পরেই শ্রীলঙ্কা সরকার জানিয়ে দিয়েছে, সমস্যাটি “সমাধান করা হয়ে গিয়েছে। তবে মাছ ধরার অধিকার, জীবিকা এবং আঞ্চলিক সীমানা নিয়ে আলোচনা চলছে। 

তবে সাবেক  কূটনীতিক এবং বিশ্লেষকদের মতে, কচ্ছতিভুকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর স্থায়ী সমাধানের দিকে সব পক্ষের মনোযোগ দেয়া উচিত। স্থানীয় মৎস্যজীবীদের জীবন জীবিকার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়া দরকার বলে তারা জানিয়েছেন। সূত্র: মানবজমিন 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়