জাকার্তাভিত্তিক ভূমি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পিটি ইয়ার্ড জিল ইন্দোনেশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা গাও শিয়াওই জানান, সম্প্রতি চীনা কোম্পানিগুলোর আগ্রহ এতটাই বেড়েছে যে, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাদের মিটিং চলছে। ২০২১ সালে মাত্র চার কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ৪০ জনের বেশি কর্মী রয়েছে। তিনি বলেন, ‘শিল্প পার্কগুলোও এখন খুব ব্যস্ত।’
যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ আমদানি শুল্ক থেকে রক্ষা পেতে ইন্দোনেশিয়ায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন বা সম্প্রসারণে ঝুঁকছে চীনা কোম্পানিগুলো। এর ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি এবং বিশ্বের চতুর্থ জনবহুল দেশটিতে বিনিয়োগের নতুন ঢল নেমেছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ইন্দোনেশিয়ার পণ্য রপ্তানিতে শুল্কহার ১৯ শতাংশ, যা মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডের সমান এবং ভিয়েতনামের (২০ শতাংশ) চেয়ে সামান্য কম। চীনের ক্ষেত্রে এই হার ৩০ শতাংশের বেশি। এই ব্যবধানই চীনা কোম্পানিগুলোকে ইন্দোনেশিয়ার দিকে ঝুঁকিয়ে দিচ্ছে।
শুল্কসুবিধার পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ তার বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজার। মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ বিক্রেতা চীনা ব্যবসায়ী ঝাং চাও বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়ায় শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে পারলে কার্যত অর্ধেক দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় বাজার দখল করা সম্ভব।’
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতি ৫ দশমিক ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা গত দুই বছরের মধ্যে দ্রুততম। প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে উদ্যোগী। গত নভেম্বরে তিনি বেইজিং সফরে প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং এ বছরের মে মাসে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংকে জাকার্তায় স্বাগত জানান।
২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে চীন ও হংকং থেকে ইন্দোনেশিয়ায় বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৬ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। একই সময়ে মোট বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। সরকার আশা করছে, বছরের দ্বিতীয়ার্ধে বিনিয়োগ আরও বাড়বে।
তবে বিনিয়োগ পরিবেশে এখনো রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। জটিল প্রশাসনিক প্রক্রিয়া, বিধিনিষেধ, মালিকানা সীমাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং পূর্ণাঙ্গ শিল্প সরবরাহ শৃঙ্খলের অভাব বিনিয়োগকারীদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। এ ছাড়া প্রাবোওর ব্যয়বহুল জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি, যেমন—স্কুল শিক্ষার্থী ও গর্ভবতী নারীদের বিনা মূল্যে খাবার বিতরণ, তার আর্থিক শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
পশ্চিম জাভার সুবাং স্মার্টপলিটান শিল্প পার্কে চীনা বিনিয়োগকারীদের অনুসন্ধান বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। পার্ক পরিচালনাকারী সুরিয়াসিপ্তা স্ওয়াদায়ার এক কর্মকর্তা জানান, যুক্তরাষ্ট্র-ইন্দোনেশিয়া বাণিজ্য চুক্তি ঘোষণার পর থেকে ফোন, ই-মেইল ও উইচ্যাটে নতুন ক্রেতার খোঁজে বার্তা আসছে এবং সবাই চীন থেকে।
খেলনা, টেক্সটাইল থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারকেরা বিশেষ করে পশ্চিম জাভার দিকে নজর দিচ্ছে, যেখানে রয়েছে পাতিমবান গভীর সমুদ্রবন্দর।
চীনা কোম্পানির চাহিদার কারণে ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে শিল্প কারখানা স্থাপনের উপযোগী জমি ও গুদামের দাম বছরে ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে, যা গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি। গ্লোবাল প্রোপার্টি কনসালট্যান্ট কলিয়ার্স ইন্টারন্যাশনালের ইন্দোনেশিয়া শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় প্রতিদিন শিল্প জমি খুঁজছে এবং দ্রুত ব্যবহারযোগ্য জমি ও অস্থায়ী ভবন চাইছে—এ যেন একধরনের ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’।
ব্যবসায়ী ঝাং জানান, তিনি মে মাসে জাকার্তায় চারতলা অফিস ভবন ভাড়া নিয়েছেন বার্ষিক ১ লাখ ইউয়ানে (১৩ হাজার ৯৩৬ ডলার), যা গত বছরের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি। তাঁর মতে, চীনে যেখানে মুনাফার হার ৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে, ইন্দোনেশিয়ায় সহজেই ২০ থেকে ৩০ শতাংশ নেট মুনাফা অর্জন সম্ভব।
ইন্দোনেশিয়ায় গৃহস্থালি ব্যয় জিডিপির অর্ধেকের বেশি। ২০২৫ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এ খাতের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ, যা সরকারি ছুটি বৃদ্ধির কারণে কিছুটা ত্বরান্বিত হয়েছে।
বিনিয়োগ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিজান শিরা অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের আসিয়ান পরিচালক মার্কো ফস্টার বলেন, ‘সরবরাহ শৃঙ্খল বৈচিত্র্যের বাইরেও ইন্দোনেশিয়ার মূল শক্তি তার বিশাল দেশীয় বাজার, যা এই অঞ্চলের অন্য কোনো দেশে নেই।’ অনুবাদ: আজকের পত্রিকা