এল আর বাদল : ইসরায়েলের সাথে সংঘাতের পর ইরানে বেড়ে গেছে গ্রেফতার। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার সাথে জড়িত সন্দেহে এসব গ্রেফতার চালাচ্ছে ইরান। বেশ কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর করেছে দেশটি।
দেশটির কর্মকর্তারা মনে করছেন তাদের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোয় ইসরায়েলি চরদের নজিরবিহীন অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
ইরানের কর্তৃপক্ষ সন্দেহ করছে, ইসরায়েলকে এসব চরদের দেওয়া তথ্য সাম্প্রতিক সংঘাতের সময় একাধিক হাই-প্রোফাইল ব্যক্তির হত্যাকাণ্ডে ভূমিকা রেখেছিল।
এর মধ্যে রয়েছে ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কোর বা আইআরজিসির সিনিয়র কমান্ডার এবং পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে হত্যা, যার জন্য ইরান দেশের অভ্যন্তরে কর্মরত ইসরায়েলের মোসাদ গোয়েন্দা সংস্থার কর্মীদের দায়ী করে।
এই হত্যাকাণ্ডের মাত্রা এবং নির্ভুলতা দেখে হতবাক হয়েছে ইরানের কর্তৃপক্ষ। তাই এখন বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সাথে কাজ করছে এমন সন্দেহভাজন যে কাউকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। তারা বলছে যে এটি জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে করা হচ্ছে। -- সূত্র, বিবিসি বাংলা
কিন্তু অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে এটি ভিন্নমত দমন এবং নাগরিকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ জোরদারে ব্যবহার করা হতে পারে।
১২ দিনের সংঘাতের সময়, ইরানি কর্তৃপক্ষ ইসরায়েলের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। বুধবার - যুদ্ধবিরতির ঠিক একদিন পরে - একই অভিযোগে আরও তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে দেশজুড়ে শত শত সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তারের ঘোষণা দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বেশ কয়েকজন আটক ব্যক্তির কথিত স্বীকারোক্তি সম্প্রচার করেছে, যারা ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার সাথে সহযোগিতার কথা স্বীকার করেছে।
মানবাধিকার গোষ্ঠী এবং কর্মীরা সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, ইরানের দীর্ঘদিন ধরে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় ও অন্যায্য বিচারের চর্চা আছে। আরও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে পারে এমন উদ্বেগও রয়েছে।
ইরানের গোয়েন্দা বিষয়ক মন্ত্রণালয় দাবি করেছে যে তারা পশ্চিমা ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক - যার মধ্যে সিআইএ, মোসাদ এবং এমআই-৬ রয়েছে - এর বিরুদ্ধে "নিরলস যুদ্ধ" চালিয়ে যাচ্ছে।
আইআরজিসির সাথে সম্পর্কিত ফার্স নিউজ এজেন্সির মতে, গত ১৩ই জুন ইরানে ইসরায়েলের আক্রমণ শুরুর পর থেকে "ইসরায়েলি গুপ্তচর নেটওয়ার্ক দেশের অভ্যন্তরে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছে"।
ফার্স জানিয়েছে, সংঘাতের ১২ দিনে ইরানি গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বাহিনী "এই নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত ৭০০ জনেরও বেশি ব্যক্তিকে" গ্রেফতার করেছে।
ইরানি অনেক নাগরিক বিবিসি পার্সিয়ান সার্ভিসকে জানিয়েছেন, তারা ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় থেকে সতর্কীকরণ টেক্সট বার্তা পেয়েছেন যেখানে তাদের ফোন নম্বর ইসরায়েল সম্পর্কিত সোশ্যাল মিডিয়ার পেজে প্রকাশিত হয়েছে। তাদের এই পেজগুলো ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, অন্যথায় তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
ইরান সরকার বিবিসি পার্সিয়ান সার্ভিস, লন্ডন-ভিত্তিক ইরান ইন্টারন্যাশনাল এবং মানোতো টিভি-সহ বিদেশে ফার্সি ভাষার মিডিয়া আউটলেটগুলোয় কাজ করা সাংবাদিকদের ওপরও চাপ বাড়িয়েছে।
ইরান ইন্টারন্যাশনাল বলছে, তেহরানে তাদের একজন টিভি উপস্থাপককে পদত্যাগে চাপ সৃষ্টি করার জন্য তার মা, বাবা ও ভাইকে আটক করে আইআরজিসি। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের সময় চ্যানেলটির কাভারেজের কারণে তারা এটা করে।
ওই উপস্থাপক তার বাবার কাছ থেকে একটি ফোন কল পেয়েছিলেন, এবং তার বাবা তাকে পদত্যাগের অনুরোধ জানান। তাকে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা চাপ দিয়েছিলেন এবং আরও কঠোর পরিণতির জন্য তাকে সতর্কও করা হয়েছিল।
সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে বিবিসি পার্সিয়ান সার্ভিসের সাংবাদিক এবং তাদের পরিবারের ওপর হুমকি ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠেছে।
আক্রান্ত সাংবাদিকরা বলছেন, ইরানের নিরাপত্তা কর্মকর্তারারা তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে বলেছেন যে যুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপটে তাদের পরিবারের সদস্যদের জিম্মি হিসেবে টার্গেট করা ন্যায্য। তারা সাংবাদিকদের "মোহরেব" হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন - যার অর্থ 'ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী'- এমন একটি অভিযোগ যার কারণে তারা ইরানের আইন অনুসারে মৃত্যুদণ্ডেরও সম্মুখীন হতে পারেন।
মানোতো টিভি একই ধরনের ঘটনা রিপোর্ট করেছে, যার মধ্যে রয়েছে কর্মচারীদের পরিবারের বিরুদ্ধে হুমকি এবং আউটলেটের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি। কিছু আত্মীয়কে "ঈশ্বরের বিরুদ্ধে শত্রুতা" এবং গুপ্তচরবৃত্তির মতো অভিযোগে অভিযুক্ত করার হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে – উভয়ের জন্যই ইরানের আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে।
বিশ্লেষকরা এই কৌশলগুলোকে ভিন্নমত স্তব্ধ করা এবং নির্বাসিত মিডিয়া কর্মীদের ভয় দেখানোর একটি বৃহত্তর কৌশলের অংশ হিসেবে দেখছেন।
নিরাপত্তা বাহিনী অনেক ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ছাড়াই কয়েক ডজন কর্মী, লেখক ও শিল্পীকে আটক করেছে। ২০২২ সালের "নারী, জীবন, স্বাধীনতা" সরকারবিরোধী বিক্ষোভের সময় নিহতদের পরিবারের সদস্যদের গ্রেপ্তারের খবরও রয়েছে।
এই পদক্ষেপগুলো কেবল বর্তমান অ্যাক্টিভিস্টদের টার্গেট করেই হচ্ছে না, বরং আগেও বিভিন্ন সময়ে ভিন্নমতের আন্দোলনের সাথে যুক্তদের বিরুদ্ধেও একটি বৃহত্তর অভিযানের ইঙ্গিত দেয়।
ইসরায়েলের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘাতের সময় ইরান সরকার ইন্টারনেটে প্রবেশের সুযোগ কঠোরভাবে সীমাবদ্ধ করেছিল। যুদ্ধবিরতির পরেও তা সম্পূর্ণভাবে উন্মুক্ত করা হয়নি।
সংকটের সময়, বিশেষ করে সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিক্ষোভের সময় ইন্টারনেট সেবা সীমিত করা ইরানের একটি সাধারণ ধরন হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপরন্তু, ইনস্টাগ্রাম, টেলিগ্রাম, এক্স এবং ইউটিউবের মতো বেশিরভাগ সামাজিক নেটওয়ার্ক, সেইসাথে বিবিসি পার্সিয়ানের মতো সংবাদ ওয়েবসাইটগুলোও দীর্ঘদিন ধরে ইরানে অবরুদ্ধ রয়েছে। ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) প্রক্সি পরিষেবা ব্যবহার না করে এগুলো ব্যবহার করা যায় না।
মানবাধিকার সমর্থক এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরাএ পরিস্থিতিকে ১৯৮০-এর দশকের সাথে তুলনা করেছেন, যখন ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ইরানি কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্মমভাবে দমন করেছিল।
অনেকের আশঙ্কা, ইসরায়েলের সাথে সংঘর্ষের পর আন্তর্জাতিকভাবে দুর্বল অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ইরানি কর্তৃপক্ষ আবারও অভ্যন্তরীণ দমন-পীড়নের দিকে ফিরে যেতে পারে—যার অংশ হিসেবে ব্যাপক গ্রেপ্তার, মৃত্যুদণ্ড এবং কঠোর দমননীতি গ্রহণ করা হতে পারে।
সমালোচকরা ১৯৮৮ সালের ঘটনাবলীর দিকে ইঙ্গিত করেন, যখন মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর মতে, হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দির, যাদের অনেকেই ইতোমধ্যেই সাজা ভোগ করছেন, তথাকথিত "মৃত্যু কমিশন" দ্বারা সংক্ষিপ্ত, গোপন বিচারের পর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। বেশিরভাগ ভুক্তভোগীকে অচিহ্নিত গণকবরে সমাহিত করা হয়েছিল।