আলজাজিরা বিশ্লেষণ: ইরানে ইসরায়েলের হামলার পর আন্তর্জাতিক শেয়ার বাজার উত্তাল হয়ে উঠলেও তা স্থিতিশীল হয়ে উঠতে শুরু করেছে। তবে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী অঞ্চলে এই সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ক্রমশ বাড়ছে। ইরান ও ইসরায়েল উভয় পক্ষ প্রতিপক্ষের জ্বালানি খাতে হামলা চালিয়েছে। আলজাজিরার বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের দুটি সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর মধ্যে সংঘাত যখন পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আর্থিক বাজার এবং বিমান চলাচল খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্লেষকরা তেলের দামের দিকে নজর রাখছেন, এবং বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণের বিনিয়োগের মত নিরাপদ আশ্রয়স্থলের দিকে ঝুঁকছেন। এবং একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।
তেলের দাম বৃদ্ধি
ব্রেন্ট ক্রুড, সোমবার ভোরে প্রতি ব্যারেল বেড়ে দাঁড়ায় ৭৪.৬০ ডলার। যা বৃহস্পতিবারের তুলনায়, ইসরায়েলের আকস্মিক আক্রমণের আগের দিন থেকে এটি প্রায় ৭ শতাংশ বেশি। ইরানের গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণেতা ইসমাইল কোসারির উদ্ধৃতি দিয়ে ইরানের সংবাদ সংস্থা আইআরআইএনএন জানিয়েছে যে ইসরায়েলের সাথে সংঘাত তীব্রতর হওয়ার সাথে সাথে তেহরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার কথা বিবেচনা করছে। এ প্রণালী প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ১০ লক্ষ ব্যারেল পরিবহন করে। গোল্ডম্যান শ্যাক্সের মতে, হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা হলে তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারে উঠতে পারে।
তবে কৌশল ও রাজনৈতিক গবেষণা সংস্থা টিএস লম্বার্ডের অর্থনৈতিক বিশ্লেষক হামজেহ আল গাওদের মতে, “প্রণালী বন্ধ করার প্রভাব তেহরানের জন্যই মারাত্মক হবে, কারণ চীনে ইরানের তেল রফতানি বিঘ্নিত হবে।”
বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির হার কি প্রভাবিত হয়েছে?
তেলের দাম বৃদ্ধিতে উৎপাদন খরচও বেড়ে গিয়ে ভোক্তাদের উপর, বিশেষ করে খাদ্য, পোশাক এবং রাসায়নিকের মতো জ্বালানি-ঘন পণ্যের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। যদি এই সংঘাত অব্যাহত থাকে তবে বিশ্বজুড়ে তেল আমদানিকারক দেশগুলি উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্মুখীন হতে পারে। সামনের দিকে তাকিয়ে, বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে ক্রমবর্ধমান দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি নীতিগত নমনীয়তার সম্মুখীন হবে। আল গাওদ আল জাজিরাকে বলেন, “জি৭-এর কেন্দ্রীয় ব্যাংকাররা বর্তমানে [সুদের হার] হ্রাসের চেষ্টা করছেন, তাই সম্ভাব্য জ্বালানি মূল্যের ধাক্কা সম্পর্কে তারা চিন্তিত।”
ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের বেস সুদের হার ৪.২৫ শতাংশে কমিয়ে এনেছে, যদিও জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ট্রাম্পের প্রায় সকল দেশের উপর শুল্ক আরোপের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার কমানো থেকে বিরত রয়েছে।
বাজার কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে?
ওয়াল স্ট্রিট এর উপর প্রভাব পড়েছে। শুক্রবার, ঝ্চ ৫০০ এবং ঘধংফধয় ঈড়সঢ়ড়ংরঃব সূচক যথাক্রমে ১.১ এবং ১.৩ শতাংশ কমেছে। মধ্যপ্রাচ্যে, রোববার মিশরের বেঞ্চমার্ক ঊএঢ ৩০ সূচক ৭.৭ শতাংশ কমেছে এবং তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জ ৩৫ সূচক ১.৫ শতাংশ কমেছে।
ইসরায়েলের আক্রমণের খবরে ইউরোপীয় ইক্যুইটিও হ্রাস পেয়েছে। গত সপ্তাহের শেষে জার্মানির উঅঢ এবং ফ্রান্সের ঈঅঈ ৪০ ১.১ শতাংশের কিছু বেশি কমেছে, শুক্রবার যুক্তরাজ্যের ঋঞঝঊ ১০০ ০.৫ শতাংশ কমেছে। তবুও, কিছু যুক্তরাজ্যের কোম্পানির শেয়ার মূল্য বেড়েছে। প্রতিরক্ষা ঠিকাদার ইঅঊ সিস্টেমস শুক্রবার প্রায় ৩ শতাংশ বেড়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, লকহিড, নর্থরপ গ্রুমম্যান এবং জঞঢ সহ সামরিক সরবরাহকারীদের শেয়ারের দামও বেড়েছে। তেল কোম্পানি বিপি এবং শেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, যার মধ্যে প্রথমটির দাম প্রায় ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দ্বিতীয়টির দাম মাত্র ১ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।
শুক্রবার সোনার দামও প্রায় ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে প্রতি আউন্স ৩,৪২৬ ডলারে লেনদেন হয়েছে, যা এপ্রিলে রেকর্ড সর্বোচ্চ ৩,৫০০ ডলারের কাছাকাছি।
সোমবার, তেল ও সোনার দাম কমে যাওয়া এবং শেয়ারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা তাদের ঝুঁকি-মুক্ত অবস্থান কিছুটা কমিয়েছেন। আল গাওদ বলেন, “মনে হচ্ছে বাজারগুলি ধারণা করছে যে সংঘাত তুলনামূলকভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ইরান এই অঞ্চলে কোনও মার্কিন সামরিক সম্পদে আক্রমণ করেনি।”
আকাশসীমা বন্ধে বিমান খাতে কী প্রভাব পড়েছে?
মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম বিমান সংস্থা এমিরেটস জানিয়েছে যে তারা ৩০ জুন পর্যন্ত ইরাক, জর্ডান, লেবানন এবং ইরানের সাথে রোববার পর্যন্ত ফ্লাইট স্থগিত রেখেছে।
ইতিহাদ এয়ারওয়েজ রোববার পর্যন্ত আবুধাবি এবং তেল আবিবের মধ্যে সমস্ত ফ্লাইট বাতিল করেছে। বিমান সংস্থাটি আরও বেশ কয়েকটি পরিষেবা পুনরায় চালু করছে এবং গ্রাহকদের তাদের ফ্লাইটের অবস্থা সম্পর্কে আপডেটের জন্য অপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছে।
চলমান উত্তেজনার কারণে কাতার এয়ারওয়েজ ইরান, ইরাক এবং সিরিয়ার সাথে ফ্লাইট সাময়িকভাবে বাতিল করেছে, যাত্রীদের ভ্রমণের আগে তাদের ফ্লাইটের অবস্থা পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
অন্যত্র, ইরানের সরকারী সংবাদ সংস্থা আইআরএনএ জানিয়েছে যে বিমান কর্তৃপক্ষ পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত দেশের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে।
ইরাকি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে যে শুক্রবার, ইরাকও তার আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে এবং তার বিমানবন্দরগুলিতে সমস্ত যানবাহন চলাচল স্থগিত করেছে। পূর্ব ইরাক বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ততম বিমান করিডোর। ইউরোপ এবং উপসাগরের মধ্যে যে কোনও মুহূর্তে কয়েক ডজন ফ্লাইট সেখানে যাতায়াত করে - অনেকগুলি এশিয়া থেকে ইউরোপের রুটে।
জর্ডানের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে “এই অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট যেকোনো বিপদের আশঙ্কায়” তারা “সাময়িকভাবে” জর্ডানের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে।
আল গাওদের মতে, “মধ্যপ্রাচ্যের পর্যটনে স্বল্পমেয়াদী ব্যাঘাত ঘটতে পারে তবে মাত্র এক মাসের জন্য। আমার সন্দেহ পর্যটন আবার ঘুরে দাঁড়াবে।”
