তেলের বাজারে প্রভাব বাড়াতে আবারও আগ্রাসী কৌশলের ইঙ্গিত দিয়েছে সৌদি আরব। সম্প্রতি ওপেক সদস্য দেশগুলোকে শায়েস্তা করতে দেশটি তেলের দামে বড় রকমের ধাক্কা দিতে পারে বলে আভাস মিলেছে। তবে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকট এবং তেলের চাহিদা হ্রাসের প্রেক্ষাপটে এবারের প্রচেষ্টা আগের মতো কার্যকর না-ও হতে পারে।
সম্প্রতি সৌদি জ্বালানিমন্ত্রী প্রিন্স আবদুল আজিজ বিন সালমান সম্প্রতি ওপেক জোটের কিছু সদস্যের উৎপাদন সীমা মানা ও না মানা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করলেও, গত শনিবার থেকে ওপেক প্লাসের ছয়টি প্রধান সদস্য, যার মধ্যে রাশিয়া ও কাজাখস্তানও রয়েছে। টানা দ্বিতীয় মাসের মতো উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে উল্টো বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে।
আগামী জুনে দৈনিক ৪ লাখ ১১ হাজার ব্যারেল তেল বাড়ানোর সিদ্ধান্তের ফলে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত মোট ৯ লাখ ৬০ হাজার ব্যারেল নতুন তেল বাজারে প্রবেশ করবে। এর ফলে আগেই চাহিদার তুলনায় বেশি জোগান থাকা বাজারে আরও চাপে পড়বে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া তথ্যমতে, এই বৃদ্ধি আরও দ্রুত হতে পারে এবং নভেম্বরের মধ্যে প্রতিদিন ২২ লাখ ব্যারেল অতিরিক্ত তেল বাজারে ছাড়তে পারে ওপেক। তাদের এই ঘোষণা বাজারকে চমকে দিয়েছে। গতকাল সোমবারের মধ্যে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম নেমে গেছে ৬০ ডলারের নিচে, যা অনেক তেল উৎপাদক দেশের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়াবে।
এমনকি অক্টোবরের পর থেকে তেলের ভবিষ্যৎ চুক্তির দাম এখন কন্ট্যাঙ্গো কাঠামোতে—অর্থাৎ ভবিষ্যতের ডেলিভারির দামের চেয়ে বর্তমান দাম কম, যা অতিরিক্ত জোগানের ইঙ্গিত দেয়। এতে অনেক আমেরিকান শেল উৎপাদক নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ থেকে সরে আসতে পারেন।
এই পরিস্থিতি পরিচিত মনে হলেও, এবার সৌদি আরব ভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে। ২০১৪ সালে শেল তেল উৎপাদকদের রুখতে বাজারে সস্তা তেল ছেড়ে দেয় রিয়াদ। ২০২০ সালের মহামারির মধ্যেও একইভাবে রাশিয়ার সঙ্গে উত্তেজনা ছড়িয়ে বাজারকে চাপে ফেলে তারা।
কিন্তু এবারের পরিস্থিতি আলাদা। তেলের দাম কমলে সাধারণত এশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাজারে চাহিদা বাড়ে। ২০১৫ সালে যেমন তেলের দাম কমে যাওয়ার পর বিশ্বে চাহিদা বেড়ে যায় দৈনিক ২০ লাখ ব্যারেল, যা দশকের গড় প্রবৃদ্ধির চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু এবার তেলের ২০ শতাংশ দামের পতন এসেছে মূলত বৈশ্বিক চাহিদা নিয়ে শঙ্কা থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য উত্তেজনা এবং বড় বড় কোম্পানিগুলোর সতর্ক বার্তা এসব শঙ্কা বাড়িয়েছে। তাই আগের মতো দাম কমালে এবারও চাহিদা বাড়বে, এমন নিশ্চয়তা নেই।
পরিস্থিতি এমন হতে পারে যে তেলের চাহিদা যখন কমছে, তখন দেশগুলো উল্টো একে অপরের বাজার দখলের লড়াইয়ে নামবে। এতে বাজারে আরও অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে এবং সৌদি আরবের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
১৯৯৭ সালের এশীয় আর্থিক সংকটের আগেও রিয়াদ ওপেক উৎপাদন কোটা বাড়িয়েছিল, যার ফলে এক বছরে তেলের দাম ৫০ শতাংশ পড়ে যায়। এবারের পরিস্থিতির সঙ্গে ওই সময়ের মিল রয়েছে।
সৌদি সরকারের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, দাম পড়লেও টিকে থাকার সক্ষমতা তাদের আছে। সরকারি বিনিয়োগ তহবিল (পিআইএফ) চলতি বছরে ইতিমধ্যে ১১ বিলিয়ন ডলারের ইসলামি বন্ড (সুকুক) তুলেছে এবং আরও ২ বিলিয়ন ডলার তুলতে চাইছে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে দাম কম থাকলে সৌদি আরবকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতে, ২০২৫ সালের বাজেট ভারসাম্য রাখতে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৯০ ডলারের বেশি প্রয়োজন। অন্যদিকে বাজারে দীর্ঘস্থায়ী দুর্বলতা ওপেক দেশগুলোর মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, যা সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই জোটকে ভেঙে দিতে পারে। এ ছাড়া, তেলের দাম দীর্ঘ সময় ধরে কম থাকলে দেশটির বাজেটও চাপের মুখে পড়বে।
সব মিলিয়ে, সৌদি আরব চাইলেই তেলের দামে যুদ্ধ শুরু করতে পারে, কিন্তু জয়লাভের পথ এবার অত সহজ নয়। কারণ, বিশ্ব অর্থনীতির দুর্বল চাহিদা তাদের এই কৌশলকে ব্যর্থ করতে পারে। বিশেষত যখন চাহিদা নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের মতো অর্থনৈতিক পরাশক্তির আচরণের ওপর।