এম এইচ বাচ্চু :সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে নুতন করে চাপে রয়েছে ভারত। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের নেতারা গণহত্যা চালানো শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ায় ভারতের বিরুদ্ধে আঙুল তুলছে । এই অবস্থায় বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া নরেন্দ্র মোদি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হবে তা নিয়ে।
শেখ হাসিনাকে যদি ফের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয় ভারত তাহলে বিশ্ব রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছেও ভিন্ন বার্তা যাবে। সব মিলিয়ে এই অবস্থায় নিজেদের দেশে শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়ে গেছে মোদি সরকার। এশিয়ায় মধ্যে ভারতের সবচেয়ে ভালো বন্ধু বাংলাদেশ ও শেখ হাসিনা। সেটাও এখন হুমকির মুখে পাড়েছে।
বাংলাদেশে এখন একটি ভয়ঙ্কর কূটনেতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি নয়াদিল্লি। সম্পর্কটি নিকট ভবিষ্যতে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। উপরন্তু জামায়াতে ইসলামী অব্যাহতভাবে ভারতের জন্য উদ্বেগের। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে অদম্য সমর্থন দেয় ভারত। এতে যে তিক্ততা ও ক্ষোভ রয়েছে তাতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত খুব সহজ হবে না।
আউটলুক ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের সাউথ ব্লকে বর্তমানে ক্ষমতার করিডোরে খুব বেশি গুঞ্জন শোনা যাবে একটি কথা- ‘স্ট্র্যাটেজিক প্যাশেন্স’ বা কৌশলগত ধৈর্য। ২০১৫ সালে প্রথম এই টার্মটি ব্যবহার করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ভারতের দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীদের অস্থিরতা বর্ণনার জন্য এটা একটা যোগ্য বাক্যাংশ। ২০১৪ সালে আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণিকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছিল ভারত। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় জনতার বিদ্রোহ, মালদ্বীপে ‘ইন্ডিয়া আউট আন্দোলন, নেপালে ঘন ঘন নেতৃত্বের পরিবর্তনের ফলে এসব দেশকে হয়তো ভারত না হয় চীনের মুখাপেক্ষী করে ফেলেছে।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে ভারতের কংগ্রেস পার্টির এমপি শশী থারুর বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তান দরজার ওপারের এমন দুই প্রতিবেশী, যাদের মধ্যে কথা বলা একরকম বন্ধই আছে এবং ভারতের দৃষ্টিতে এটিই ঠিক আছে। তবে যেহেতু দীর্ঘদিন থেকেই ভারতকে নিশানা করা সন্ত্রাসবাদীরা মূল ঘাঁটি হিসেবে পাকিস্তানের মাটিকে ব্যবহার করে আসছে, সেহেতু ভারত চাইলেও সব সময় পাকিস্তানকে উপেক্ষা করতে পারে না।
পাকিস্তানের মাটি থেকে ভারতে এ পর্যন্ত যতগুলো সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়েছে, তার মধ্যে ২০০৮ সালের নভেম্বরের হামলাটি সবচেয়ে কুখ্যাত। ওই সময় পাকিস্তানের সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা মুম্বাইতে ঢুকে পড়ে চার দিন ধরে গুলি ও বোমা হামলা চালিয়েছিল। তাতে ১৭০ জনেরও বেশি লোক নিহত হয়েছিলেন। ভারতের দিক থেকে নেওয়া নীতিগত সিদ্ধান্ত হলো, যতক্ষণ না পাকিস্তান তার সীমানার ভেতর থেকে ইসলামপন্থী সন্ত্রাস দমন করতে অক্ষম থাকবে কিংবা সন্ত্রাস দমনে অনিচ্ছুক থাকবে ততক্ষণ দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সুসম্পর্ক অধরা থেকে যাবে।
ভারত ও নেপালের মধ্যে দীর্ঘদিন থেকে বিরোধ চলছে। ২০১৫ সালের ৩ নভেম্বর দুদেশের সীমান্ত এলাকায় নেপালি পুলিশের গুলিতে এক ভারতীয় যুবকের মৃত্যুর পর সেই পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। নেপাল থেকে সরাসরি বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত একটি করিডোরের জন্য জমি যদি ভারত নেপালকে হস্তান্তর করে, তাহলে নেপালও ভারতকে ৩১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা হস্তান্তর করতে পারে। নেপাল-ভারত সীমান্ত বিবাদ মেটাতে এরকমই একটা বিকল্পের কথা সামনে এসেছে। কিন্ত সে সাররাহা এখনও হয়নি।
ভারতের সঙ্গে ভুটানের সম্পর্ক অনেকটা কৌশগত। সীমান্তে নিজেদের কৌশলগত অবস্থান ও প্রভাব বাড়াতে ভারত ও চীন ভুটানকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। আলোপ-আলোচনার পর গত অক্টোবরে ভুটান ও চীনের মধ্যে একটি ‘সহযোগিতা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়েছে। তাদের এ চুক্তি ভারতের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে ভুটানকে ‘বাফার স্টেট’ (প্রভাবশালী দুই রাষ্ট্রের মাঝখানে দুর্বল রাষ্ট্র) হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। ভারত এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব আর বাড়তে দিতে চায় না। তারা এ অঞ্চলকে নিজের প্রভাববলয়ের বলে মনে করে থাকে। সুতরাং বাংলাদেশ, নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কাসহ এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে বেইজিংয়ের ঋণ ও নানা চুক্তির বিষয়ে নয়াদিল্লি বেশ সতর্ক দৃষ্টি রাখছে।
ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। ভারত শ্রীলঙ্কার একমাত্র প্রতিবেশী, যা পাক প্রণালী দ্বারা বিচ্ছিন্ন, উভয় রাষ্ট্রই দক্ষিণ এশিয়ায় একটি কৌশলগত অবস্থান দখল করে আছে এবং ভারত মহাসাগরে একটি অভিন্ন নিরাপত্তা ছাতা তৈরি করতে চেয়েছে। ভারত এবং শ্রীলঙ্কা উভয়ই প্রজাতন্ত্র যারা কমনওয়েলথ অফ নেশনস এর সদস্য।
ভারতের ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিসের (আইডিএসএ) গবেষক স্মৃতি পট্টনায়ক বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে বলেছেন, এটা ঠিক যে শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে ভারতের স্বার্থ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। দুই দেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও আত্মিক যোগ যেমন অনন্তকালের, তেমনই আধুনিক পৃথিবীতে ভূকৌশলগত যোগাযোগও গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণে দ্বীপরাষ্ট্র নিয়ে ভারত কখনো উদাসীন থাকেনি। থাকতে পারেও না। তবে এই মুহূর্তে সবকিছু ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে আর্থিক সংকট।
সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, আউটলুক ইন্ডিয়া, বিবিসি বাংলা।
আপনার মতামত লিখুন :