মহসিন কবির: দেশে সাইবার অপরাধে বাড়ছে। অপরাধে তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ। কেউ বুঝে আর কেউ না বুঝে অপরাধ করছেন। ধরাও পড়ছেন কিন্তু অপরাধ করছে না। গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন।
সরকারের উপদেষ্টা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা-নেত্রী, সশস্ত্র বাহিনীসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্তা-ব্যক্তিরাও সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন।
সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে এখন বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার। আগে ফটোশপ ব্যবহার করে মানুষের ছবি বিকৃত করা হতো। এখন এআই দিয়ে নিখুঁত বিকৃত ছবি ও ভিডিও তৈরি করে অপতথ্য ও গুজব ছড়ান হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, নানা সীমাবদ্ধতার কারণে দেশে বিগত বছরগুলোয় সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সাইবার অপরাধে এআই ব্যবহারের ফলে এই চ্যালেঞ্জ আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে যুগোপযোগী, কার্যকর এবং বিতর্কমুক্ত সাইবার সুরক্ষা আইন না থাকার সুযোগ নিচ্ছে সাইবার অপরাধীচক্র।
কর্মকর্তারা আরও বলেন, সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সর্বশেষ ২০২৩ সালে তৈরি করা হয় সাইবার নিরাপত্তা আইন। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার গত বছর নভেম্বরে আইনটি নীতিগতভাবে বাতিল করে দেয়। এরপর থেকে সাইবার অপরাধের ঘটনায় পুলিশ আর এই আইনে মামলা রেকর্ড করছে না। ভুক্তভোগীদের সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করার পরামর্শ দিচ্ছে। এতে সাইবার অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার সুযোগ পাচ্ছে।
ফ্যাক্টচেক প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার গত ৪ মাসে ইন্টারনেটে ১ হাজার ১৩৩টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে। এর মধ্যে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে ইন্টারনেটে ৮৩৭টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে প্রতিষ্ঠানটি, গত বছর একই সময়ের তুলনায় যা প্রায় ২৮ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে রিউমর স্ক্যানার ভুল তথ্য শনাক্ত করেছিল ৬৫৪টি। জাতীয় ও রাজনৈতিক নানা ঘটনা আর ধর্মীয় বিভিন্ন ইস্যুর কারণে চলতি বছর প্রথম প্রান্তিকে ভুল তথ্য প্রচারের হার বেড়েছে। এর আগের প্রান্তিকের (২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর) তুলনায় যা বেড়েছে প্রায় ২১ শতাংশ।
গত ৬ এপ্রিল এআই প্রযুক্তির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের নববধূ সুলতানা পারভীন ওরফে সোহা (২৩)। ১০ মাস আগে জাপানপ্রবাসীর সঙ্গে বিয়ে হয় তার। দুই মাস পরই স্বামীর সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল। প্রবাসে সোনার সংসার গড়ে তোলার স্বপ্নে বিভোর নববধূর জীবন তছনছ করে দেয় এআই প্রযুক্তি দিয়ে বানানো একটি আপত্তিকর ভিডিও, যেটি ছিল ভুয়া। ভিডিওটি একটি ফেক আইডি থেকে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই ভিডিও প্রথমে সুলতানাকে এবং পরে তার স্বামীকেও পাঠানো হয়। যার জেরে মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গত ৬ এপ্রিল আত্মহত্যা করেন সোহা।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, সাইবার অপরাধের শিকার যারা হন তাদের মধ্যে ৫২ শতাংশ অভিযোগই আসে নারীদের থেকে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সি মেয়েরা, যা প্রায় ৭৪ শতাংশ। অভিযোগের একটি বড় অংশের অভিযোগ ফেসবুক সংক্রান্ত। যার মধ্যে আইডি হ্যাক থেকে শুরু করে সুপার ইম্পোজ ছবি এবং পর্নোগ্রাফির মতো ভয়াবহ অভিযোগও রয়েছে।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার ২০২০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ৫ বছরে ১ লাখ ৬৪ হাজার ২১টি অভিযোগ পায়। এসব অভিযোগের মধ্যে নারীঘটিত অনলাইন হয়রানি, অনলাইন কেনাকাটা, মোবাইল ব্যাংকিং ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, অনলাইন জুয়া এবং ফেসবুক আইডি হ্যাকিং সংক্রান্ত অভিযোগই বেশি আসে। অভিযোগকারীদের একটি বড় অংশই নারী।
সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করা পুলিশের একাধিক ইউনিটের কর্মকর্তারা বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে সাইবার অপরাধ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এই অপরাধের ধরনও দিন দিন বদল হচ্ছে। একসময় ফটোশপ দিয়ে ছবি বিকৃত করে সাইবার অপরাধ করা হতো। এখন এআই দিয়ে নিখুঁতভাবে এ কাজটি করা হচ্ছে। নিত্যনতুন পন্থা অবলম্বন করে প্রতারণা বা বুলিং করছে সাইবার অপরাধীরা। কিন্তু আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে কার্যকর আইন না থাকায় তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইনি ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল হওয়ায় তারা মামলাও নিতে পারছেন না। যে কারণে আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে তারা ভুক্তভোগীকে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করার পরামর্শ দিচ্ছেন। পুলিশ কর্মকর্তারা সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতার ঘাটতি এবং প্রযুক্তিগত অক্ষমতাকেও দায়ী করছেন।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত ডিআইজি এসএম আশরাফুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেছেন, ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে যে ব্যক্তি সাইবার অপরাধ করছে, তদন্তকালে ওই ডিভাইসটি জব্দ করে ফরেনসিক করতে হবে। তারপর মামলা করতে হবে। এখন আমরা মামলা নিতে পারছি না। মামলা হচ্ছে সাইবার ট্রাইব্যুনালে। সাইবার ট্রাইব্যুনাল পুলিশকে প্রতিবেদন দিতে বলেন। এ কাজ করতে পুলিশ বাদী ও বিবাদীকে নোটিশ করে। বিবাদী এলেও অপরাধে ব্যবহৃত ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে আসে না। আবার অপরাধের লিংক ডিলিট করে দিয়ে আসছে। তদন্তকালে ডিজিটাল ডিভাইস ও লিংক খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই দুটি যখন তদন্ত কর্মকর্তা পাচ্ছেন না, তখন মামলা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। তখন আর অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনার সুযোগ থাকছে না। অপরাধী ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর সাইবার অপরাধ বেড়ে গেছে। বিশেষ করে এআই দিয়ে তৈরি মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ছে ইন্টারনেটে। এর মধ্যে সমসাময়িক ঘটনাবলী এবং রাজনীতি বিষয়ে বেশি অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রধান উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা, সেনাপ্রধান, আইজিপি, জামায়াতে ইসলামীর আমির, বিএনপি মহাসচিবসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং বিনোদন জগতের তারকাদের নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর ঘটনা বেড়ে গেছে।
গত ৪ এপ্রিল ‘আপনার প্রথম ডাউনলোডে ৯৯ পান’ ক্যাপশনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থাপনায় একটি জুয়ার বিজ্ঞাপনের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করা হয়। যেখানে তাকে ‘এই খেলায় ১০ টাকা আয় করতে পারলে তাদের ১ হাজার টাকা ব্যালান্স দেওয়া হবে। ডাউনলোড করুন এবং আমার কাছ থেকে ব্যালান্স পেতে একটি বাজি ধরুন’ বলতে শোনা যায়।
ফ্যাক্টচেক বলছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস জুয়ার অ্যাপের মাধ্যমে টাকা উপার্জনে আহ্বান করে বক্তব্য দেননি। বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পাদনার মাধ্যমে তার নামে প্রচারিত ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে।
সম্প্রতি হত্যা মামলায় কারাগারে থাকা সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের নির্দেশে মুক্তি পেয়ে গর্জে উঠেছেন শীর্ষক দাবিতে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়। কিন্তু ফ্যাক্টচেক বলছে, জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের নির্দেশে ব্যারিস্টার সুমনের মুক্তি পাওয়ার দাবিটি সঠিক নয়। বরং সেনাপ্রধানের গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় শহীদ সেনা দিবস উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যের ফুটেজ এবং ব্যারিস্টার সুমনের পুরনো ভিন্ন ঘটনার ভিডিও মিলিয়ে ওই দাবি প্রচার করা হয়েছে।
ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানারের সিনিয়র ফ্যাক্টচেকার তানভীর মাহতাব আবীর গণমাধ্যমকে বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ডিপফেক প্রযুক্তির অপব্যবহার করে সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যা বা অপতথ্য ছড়ানোর ঘটনা বেড়ে গেছে। দেশ-বিদেশ থেকে এই সাইবার অপরাধ করা হচ্ছে। কিন্তু যারা এসব ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণ কম। ফলে অপপ্রচার থামছে না।