মহসিন কবির: সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাকে হেন্থা করা দিয়ে ব্যাপক সমালোচনা করা হয়েছে। আদালতে নুরুল হুদা বলেছেন বিতর্কিত নির্বাচনের জন্য তিনি দায়ী না।
ষড়যন্ত্রমূলক ভোটারবিহীন জালিয়াতির নির্বাচন করার অভিযোগে বিএনপি'র করা মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাকে চার দিনের রিমান্ডে নেয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত। ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান আদালতে এ আদেশ দেন।
এদিন শেরেবাংলা নগর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শামসুজ্জোহা সরকার তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করেন। এ সময় রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। অপরদিকে জামিনের বিরোধিতা করে রিমান্ডে নেয়ার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে তার চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
আওয়ামী লীগ আমলে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে আসামি করে এ মামলা করে বিএনপি। মামলায় মোট ২৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। গতকাল রবিবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মো. সালাহউদ্দিন খান বাদী হয়ে এ মামলা করেন।
মামলার অভিযোগ করা হয়, ২০১৪ সালে শেখ হাসিনা সহ তার সরকার অবৈধভাবে শপথ নেওয়ার পর অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসে। পরে সেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিপরিষদ, সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের ক্যাডাররা বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর নেতা-কর্মীদের অপহরণ, গুম-খুন ও মামলা-হামলা দিয়ে নির্যাতন শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একে এম নূরুল হুদাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এরপর নুরুল হুদার অধীনেই দিনের ভোট রাতে করে একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে আবারো ক্ষমতায় আনা হয়েছিল বলে অভিযোগ করা হয়।
সিইসি হিসেবে দায়িত্ব থেকে অবসর নেওয়ার পর ঢাকার উত্তরার পাঁচ নম্বর সেক্টরের একটি বাসায় থাকতেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা। রোববার দুপুরে নুরুল হুদাসহ সাবেক তিনজন সিইসি ও ২৪ জনের নাম উল্লেখ করে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার পর এদিন সন্ধ্যায় তার উত্তরার বাসায় স্থানীয় জনগণ যায় বলে জানায় পুলিশ।
তখনকার বেশ কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেখা যায় সাবেক সিইসি মি. হুদাকে বাসা থেকে বের করে তার গলায় ‘জুতার মালা’ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে থাকা অনেকে সাবেক এই সিইসির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের স্লোগানও দিতে দেখা যায়। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায় মি. হুদার গায়ে ডিম ছুড়ে মারা হচ্ছে ও তাকে হেনস্তা করা হচ্ছে। পরে খবর পেয়ে সেখানে যায় উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ।
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদাকে ‘মব’ তৈরি করে হেনস্তার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন উপদেষ্টা।
সোমবার (২৩ জুন) সচিবালয়ে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও পরিবেশ মেলা এবং জাতীয় বৃক্ষ রোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদাকে ‘মব’ তৈরি করে হেনস্তার পর পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। পুলিশের সামনে এ ধরনের ঘটনা আপনি কীভাবে দেখছেন- জানতে চাইলে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনারা এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে একটা বক্তব্য শুনেছেন, সরকার বিবৃতি দিয়ে নিন্দা জানিয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। একটু আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন মব সৃষ্টির জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে ব্যবস্থা গ্রহণ না করা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করবো।’
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাকে আটকের সময় যেভাবে মব জাস্টিজ করা হয়েছে তা কাম্য নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে এ ধরনের ঘটনায় বাহিনীর কেউ জড়িত থাকলে তা তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সোমবার সকালে গাজীপুরের মৌচাকে হর্টিকালচার সেন্টার পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি। এ সময় গাজীপুর জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফীন, পুলিশ সুপার ড. চৌধুরী যাবের সাদেক, হর্টিকালচার সেন্টারের এনামুল হকসহ পুলিশ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, গতকাল শনিবার সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়ালকে গ্রেপ্তারের যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা সঠিক নয়। তাকে এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি। উত্তরা থেকে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা আটক হয়েছেন। তাকে আটকের সময় যেভাবে মব জাস্টিজ করা হয়েছে তা কাম্য নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে এ ধরনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ জড়িত থাকলে তা তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কৃষি জমি দখল রোধে কৃষি জমি সুরক্ষা আইন করা হচ্ছে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, বিদেশি ফলের পাশাপাশি দেশীয় ফলের উৎপাদন বাড়াতে হবে যেন এসব ফল হারিয়ে না যায়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, মব সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিএনপি, কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সোমবার দুপুরে তিনি একথা বলেন।
সালাহউদ্দিন বলেন, আমরা মব কালচারে বিশ্বাস করি না, আমরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য অবিরাম সংগ্রাম করে যাচ্ছি। আমরা চাই, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং আদালতের রায় বাস্তবায়ন হবে, বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা থাকবে।
তিনি বলেন, কে এম নুরুল হুদার সাথে যে ঘটনা ঘটেছে তা অবমাননাকর। বিএনপি এটা সমর্থন করে না। কোনো ব্যক্তি যতবড় অপরাধীই হোন না কেনো তার আইনি এবং সাংবিধানিক অধিকার যেন ভোগ করার অধিকার অক্ষুণ্ন থাকে।
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাকে রোববার রাজধানীর উত্তরা থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এসময় তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়।
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদাকে কথিত ছাত্র-জনতার হেনস্তার ঘটনায় ‘সরকারের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই’ বলে মনে করছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র–আসক।
সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আসক বলেছে, “শুধুমাত্র ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে জুন পর্যন্ত এ ধরনের অরাজকতায় উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে কমপক্ষে ৮৩ জন মানুষ নিহত হয়েছেন, যা একটি সভ্য রাষ্ট্রে ঘোরতর নৈরাজ্যের ইঙ্গিত বহন করে।”
‘জনগণের ভোট ছাড়া’ নির্বাচন সম্পন্ন করার অভিযোগে বিএনপি রোববার ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা করে, যেখানে আওয়ামী লীগের সময়ে দায়িত্ব পালন করা তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারদের আসামি করা হয়।
সাবেক সিইসি নুরুল হুদার সঙ্গে কোর্টে যারা অসদাচরণ করেছে তাদের শাস্তি দাবি করেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপির) সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। সোমবার বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ে গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, যারা বিচারের নামে মব জাস্টিস করছেন তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
রিজভী বলেন, যারা অপরাধী তাদের বিচার হবে। কিন্তু বিচার বহির্ভূতভাবে কেউ তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করবে এ ধরনের কোনো নীতিতে বিএনপি বিশ্বাস করে না। সাবেক সিইসির সঙ্গে প্রকাশ্যে যে আচরণ করা হয়েছে, সেটি নিঃসন্দেহে গর্হিত কাজ। এ ঘটনার সঙ্গে যেই জড়িত থাকুক তার বিচার দাবি করছে বিএনপি।
তিনি বলেন, আদালত প্রাঙ্গণে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। এরকম একটি স্পর্শকাতর জায়গায় মানুষ নিরাপত্তা প্রত্যাশা করে। আর সেখানে কেউ বেআইনি কাজ করবে তা হতে পারে না।