শিরোনাম
◈ বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন ◈ রংপুরের হাসপাতাল নেপাল ও ভুটানের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে: প্রধান উপদেষ্টা ◈ ড. ইউনূসের কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নেই: প্রেস সচিব ◈ ঢাকা- চট্টগ্রাম মহাসড়কের বাহারি ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ যাত্রী ও পথচারীরা ◈ আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে ডিএমপির বার্তা ◈ আ. লীগের নিবন্ধন বাতিল ইস্যুতে বৈঠক শেষে যা বলছে ইসি (ভিডিও) ◈ কক্সবাজার সদর হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার বিপর্যয়, অর্ধকোটি মানুষের মাথায় হাত! ◈ প্রবাসী আয়ে সর্বকালের রেকর্ড গড়লো বাংলাদেশ! ◈ জুলাই-আগস্টের সকল হত্যাকাণ্ডের দায় শেখ হাসিনার: চিফ প্রসিকিউটর ◈ স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে প্রয়োজন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা : প্রধান উপদেষ্টা

প্রকাশিত : ১২ মে, ২০২৫, ১২:৪০ রাত
আপডেট : ১২ মে, ২০২৫, ০৬:০০ বিকাল

প্রতিবেদক : এল আর বাদল

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ: নিবন্ধন ও জামায়াতের বিচার নিয়ে প্রশ্ন

এল আর বাদল : সন্ত্রাস দমন  আইনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার পর জন্ম নিয়েছে নানা প্রশ্ন। এই আইনে কি দল নিষিদ্ধ না করে কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা যায়? কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলে রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগের নিবন্ধনের কী হবে? আইন সংশোধনের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধে দল হিসাবে আওয়ামী লীগের বিচারের পথ খুললে ৭১ এর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান কী হবে? -- সূত্র, ড‌য়ে‌চে‌ভেলে

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আওয়ামী লীগের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। সেটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইনে রূপান্তর করা হয়েছে শনিবার রাতেই।

আওয়ামী লীগের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে সন্ত্রাস দমন আইনে। এই সিদ্ধান্তের পর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামির বিচারের বিষয়টিও নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সহ আরো কিছু রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের আন্দোলনের মুখে শনিবার রাতে উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় আওয়ামী লীগের সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, "সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি  দিতে পারবে।”

ওই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয়েছে, "আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচার কার্যসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাস বিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেস-সহ আওয়ামী লীগ এর যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।”

এর পাশাপাশি, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জুলাই ঘোষণাপত্র আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত করে প্রকাশ করার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে।

-- নিষেধাজ্ঞার ফল কী? --

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসান তারেক চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "কার্যক্রম নিষিদ্ধের মানে হলো রাজনৈতিক কার্যক্রম। এর ফলে আওয়ামী লীগ বা তার কোনো অঙ্গ সংগঠন এই নির্দেশ বহাল থাকা পর্যন্ত কোনো ধরনের রাজনৈতি কার্যক্রম চালাতে পারবে না। সভা- সমাবেশ, মিছিল বা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি চালাতে পারবে না। সেটা অফলাইন-অনলাইন সব জায়গার জন্যই প্রযোজ্য। তারা কোনো রাজনৈতি বক্তৃতা, বিবৃতি দিতে পারবেনা বা তৎপরতা চালাতে পারবে না। তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সব ধরনের কার্যালয় সিলগালা করা থাকবে।
তবে তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে কোনো প্রভাব পড়বে না এই নিষেধাজ্ঞার কারণে। বিবাহ বা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে দলের সদস্যরা অংশ নিতে পারবেন বা এই ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারবেন,” বলেন তিনি।

-- সন্ত্রাস দমন আইনে দলের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা যায়?--

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যরিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ডিডাব্লিউকে বলেন, "আইন উপদেষ্টা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন আওয়ামী লীগের সব ধরনের কার্যক্রম সন্ত্রাস দমন আইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু আইনে কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার কেনো সুযোগ নাই। তাদেরকে নিষিদ্ধ করতে হবে রাজনৈতিক দলকেই।”

তিনি জানান, "সন্ত্রাস দমন আইনের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, কেনো ব্যক্তি বা সত্ত্বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত আছে বলে সরকারের কাছে প্রতীয়মান হলে তাদের নিষিদ্ধ বা তালিকাভুক্ত করতে পারবে। আর ধারা  ছয়-এ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, যদি কেনো ব্যক্তি, সত্ত্বা বা বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশের অখণ্ডতা, সংহতি, জননিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার জন্য, জনসাধারণ বা  জনসাধারণের কোনো অংশের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার, কোনো ব্যক্তি বা সত্ত্বাকে কোনো কাজ থেকে বিরত রাখতে বাধ্য করার উদ্দেশ্যে কোনা ব্যক্তিকে হত্যা, গুরুতর আঘাত, আটক ও অপহরণ করা বা চেষ্টা করা, প্ররোচনা দেয়, প্রজাতন্ত্রের বা কোনো ব্যক্তির ক্ষতি বা ক্ষতির চেষ্টা করা হলে তা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।

তিনি বলেন, "এই আইনে ব্যক্তিকে হত্যা করলেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হবে না। বাংলদেশের বিদ্যমান ফৌজদারি আইনে হত্যার বিচারের ব্যবস্থা আছে। সেটা নরহত্যা হিসাবে গণ্য হবে। এই আইনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হতে হলে তার উদ্দেশ্য হতে হবে চারটি- বাংলাদেশের অখণ্ডতা, সংহতি, জননিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করা।”

মানবতবিরোধী আন্তর্জাতি অপরাধ ট্রাইবুন্যালে আওয়ামী লীগের বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "১৯৭৩ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টটির সংশোধনী করা হচ্ছে। বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি সংশোধিত আইনে ধারা-২ এ একটি উপধারা যুক্ত করে রাজনৈতিক দলকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। এবং ২০(খ) ধারায় শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। সেখানে অপরাধ প্রমাণ হলে ওই  দলের কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া যাবে, ব্যান করা যাবে।

রেজিষ্ট্রেশন এবং লাইসেন্স সাসপেন্ড ও ব্যান করা যাবে এবং তাদের সম্পতি বাজেয়াপ্ত করা যাবে। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে বিচারে দোষী হওয়ার পর এবং সেটা করবে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল, সেটা সরকার করবে না।

-- অন্য রাজনৈতিক দলগুলো কী বলছে?--

অপরাধের বিচারের ব্যাপারে একমত হলেও, দল হিসাবে আওয়ামী লীগের নিষেধাজ্ঞার প্রক্রিয়া নিয়ে রয়েছে ভিন্নমত।আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে নবগঠিত দল এনসিপি। দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন বলেন, "ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগের বিচার না হওয়া পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাখার দাবি ছিলো আমাদের। সেটা হয়েছে। কিন্তু এখন দ্রুত বিচার শুরু করার দাবি জানাচ্ছি। আমরা এই বিচার পর্যবেক্ষণে রাখবো, যাতে কেউ ফাঁক গলে বের হয়ে না যায়। আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে জুলাই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত। এই দেশে তাদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নাই।”

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, "আওয়ামী লীগ যে হত্যা, গণহত্যা করেছে আমরা তার বিচার চাই। কিন্তু যে সন্ত্রাস দমন আইনে তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাকে আমরা কালো আইন বলি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের কয়েকদিন আগে জামায়াতকে ওই আইনে নিষিদ্ধ করা হয়। আমরা তার বিরোধীতা করেছি। আর সেটা তো টেকেনি। আমরা তো বিচারও চাই। বিচারের মধ্য দিয়ে যা হবার হবে। কিন্তু এইভাবে কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার আগে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে নিতে পারতো, কিন্তু করেনি। এখন দায়-দায়িত্ব সরকারের। 

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, "গত ৯ মাসে আওয়ামী লীগ তাদের অপরাধের জন্য একবার ক্ষমাও চায়নি। তারা যে হত্যা, গণহত্যা চালিয়েছে তার বিচারের দাবি আমরা শুরু থেকেই করে আসছি।  কিস্তু সরকারই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেছে।

-- ৭১-এর গণহত্যা ও জামায়াত প্রসঙ্গ --

২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম দাবি ছিল দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার। তবে আওয়ামী লীগ এর পরেও এক দশকের বেশি সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার পরও এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় আইনটি সংশোধন করেনি। এবার সেই সংশোধনীর মাধ্যমে খোদ আওয়ামী লীগেরই দল হিসাবে বিচারের পথ খুললো।

কিন্তু এরপরই প্রশ্ন উঠেছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করা দল জামায়াতে ইসলামীর বিচারের কী হবে!

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা ছাত্র প্রতিনিধি তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। ব্রিফিং শেষ হওয়ার পর এক ফেসবুক পোস্টে তিনিও এই প্রসঙ্গটি তুলেছেন।

জামায়াতের নাম উল্লেখ না করে তিনি লিখেছেন, "'৭১ এর প্রশ্ন মীমাংসা করতেই হবে। যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে পাকিস্তানপন্থা বাদ দিতে হবে। পাকিস্তান এদেশে গণহত্যা চলিয়েছে।(পাকিস্তান অফিসিয়ালি ক্ষমা চাইলেও, তদুপরি আবারো ক্ষমা চাইতে রাজি হলেও,  যুদ্ধাপরাধের সহযোগীরা এখনো ক্ষমা চায়নি)। ইনিয়ে বিনিয়ে গণহত্যার পক্ষে বয়ান উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। জুলাইয়ের শক্তির মধ্যে ঢুকে স্যাবোট্যাজ করা বন্ধ করতে হবে। সাফ দিলে আসতে হবে।

জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে মনিরা শারমিন বলেন, "আমার দলের অবস্থান আমি জানি না। তবে আমার ব্যক্তিগত মত হলো, বাংলাদেশে যারা বা যে দল গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত তাদের সবার বিচার চাই।  আইনের সংশোধনের মাধ্যমে দলের বিচারের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতে অন্য মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের পথ সুগম হয়েছে। জামায়াতকেও বিচারের আওতায় আনা উচিত। আমরা ১৯৭১ এবং ২৪ কে আলাদা করে দেখি না।”

এবিএস সাইফুল হক বলেন, "জামায়াতের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে গণহত্যার অভিযোগ, সেটা তো এখনো বিচারের আওতায় আসেনি। এটা গত ৫২-৫৪ বছর ধরে অমিমাংসিত থেকে গেছে। এটা প্রতিশোধ, প্রতিহিংসার বিষয় নয়। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার বিচারের বিষয় কখনো শেষ হবেনা। সুতরাং বিচারের এই প্রশ্ন আসবেই।

বিএনপির সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্সও একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, "একাত্তরে যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদেরও আমরা বিচার দাবি করছি। জামায়াত যদি সেই অভিযোগে অভিযুক্ত হয় তাহলে তো কিছু করার নেই। আমরা আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে বলেছিলাম। এখনো তাই বলছি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়