বাংলাদেশে পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ একটি সাধারণ ঘটনা। প্রায়ই দেখা যায়, পিতা তার জীবদ্দশায় সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি কোনো এক সন্তানকে লিখে দিয়ে অন্য সন্তানদের বঞ্চিত করেন। এই পরিস্থিতিতে আইন না জানার কারণে বঞ্চিত সন্তানেরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে সরে আসেন। কিন্তু আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্পত্তি হস্তান্তরের পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে বঞ্চিত সন্তানদের জন্য আইনি প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
পিতা যদি বেআইনি বা অসম্পূর্ণ পদ্ধতিতে সম্পত্তি হস্তান্তর করেন, তবে অন্য সন্তানরা আদালতে গিয়ে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। নিচে এমন কিছু পরিস্থিতি ও তার আইনি প্রতিকার আলোচনা করা হলো:
১. ওসিয়তনামার (Will) মাধ্যমে হস্তান্তর:
মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি তার মোট সম্পত্তির সর্বোচ্চ এক-তৃতীয়াংশ (১/৩) পর্যন্ত ওসিয়ত করতে পারেন। তবে এই ওসিয়ত কার্যকর করতে অন্যান্য ওয়ারিশদের সম্মতি প্রয়োজন হয়। যদি পিতা তার সব সম্পত্তি ওসিয়তের মাধ্যমে এক সন্তানকে দেন, তবে সেটি আইনত অবৈধ।
করণীয়: অন্য সন্তানরা এই ওসিয়তকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। আদালত তখন সকল ওয়ারিশের মধ্যে আইন অনুযায়ী সম্পত্তি বন্টন করে দেওয়ার নির্দেশ দেবেন।
২. সাদা কাগজে বা নন-রেজিস্টার্ড দলিলে হস্তান্তর:
সম্পত্তি হস্তান্তরের জন্য রেজিস্ট্রি করা বাধ্যতামূলক। যদি পিতা কেবল সাদা কাগজে, স্ট্যাম্পে বা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে সত্যায়িত কোনো দলিলে সম্পত্তি লিখে দেন, তবে সেই দলিলের আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। এটি মালিকানা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয়।
করণীয়: এই ধরনের দলিলকে আদালতে সহজেই বাতিলযোগ্য প্রমাণ করা যায়। বঞ্চিত সন্তানেরা এই দলিল বাতিলের আবেদন করে తమদের অংশ দাবি করতে পারেন।
৩. জরিপ বা খতিয়ানে একজনের নাম দেওয়া:
অনেক সময় পিতা ভূমি জরিপ চলাকালে প্রভাব খাটিয়ে বা কৌশলে এক সন্তানের নামে খতিয়ান বা রেকর্ডে নাম অন্তর্ভুক্ত করান। মনে রাখতে হবে, খতিয়ান মালিকানার চূড়ান্ত প্রমাণ নয়, এটি মূলত দখলের প্রমাণপত্র। শুধু খতিয়ানে নাম থাকার কারণে কেউ সম্পত্তির নিরঙ্কুশ মালিক হয়ে যায় না।
করণীয়: বঞ্চিত সন্তানেরা আদালতে ‘বণ্টন বা বাটোয়ারা মামলা’ করে নিজেদের অংশ দাবি করতে পারেন। আদালত তখন দলিলের ভিত্তিতে প্রকৃত মালিকানা নির্ধারণ করে রায় দেবেন।
বঞ্চিত হলে হতাশ না হয়ে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করুন:
১. আইনি পরামর্শ নিন: প্রথমেই একজন অভিজ্ঞ সিভিল আইন বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করুন এবং আপনার মামলার ভিত্তি কতটা শক্তিশালী, তা যাচাই করুন।
২. ওয়ারিশ সনদ সংগ্রহ করুন: আপনার এলাকার সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পরিবারের সকল সদস্যের নাম উল্লেখ করে একটি ওয়ারিশ সনদ সংগ্রহ করুন। এতে কাউকে বাদ দেওয়া হলে সনদটি জাল হিসেবে গণ্য হবে।
৩. বাটোয়ারা মামলা করুন: আইনজীবীর মাধ্যমে এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতে সকল ওয়ারিশকে পক্ষভুক্ত করে একটি বাটোয়ারা মামলা (Partition Suit) দায়ের করুন। এই মামলার মাধ্যমে আদালত প্রত্যেকের আইনানুগ অংশ নির্ধারণ করে দেন।
৪. রায় বাস্তবায়ন করুন: মামলার রায় আপনার পক্ষে এলে, সেই রায়ের কপি দিয়ে ভূমি অফিসে রেকর্ড সংশোধন ও নামজারি (Mutation) করে জমির মালিকানা ও দখল বুঝে নিন।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পিতা যদি তার জীবদ্দশায় সুস্থ মস্তিষ্কে ও স্বেচ্ছায় কোনো সন্তানকে রেজিস্ট্রি দলিলের মাধ্যমে সম্পত্তি হস্তান্তর করেন, তবে অন্য সন্তানদের আইনগতভাবে কিছু করার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। যেমন:
হেবা বা দান দলিল: মুসলিম আইন অনুযায়ী, পিতা তার স্বোপার্জিত সম্পত্তি যে কাউকে হেবা (দান) করতে পারেন এবং তা রেজিস্ট্রি করে দিলে সেটি বৈধ।
বিক্রয় বা সাব-কবলা দলিল: পিতা যদি তার সম্পত্তি কোনো সন্তানের কাছে বিক্রি করেন এবং তার রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হয়, তবে সেটিও আইনত বৈধ।
এই ধরনের নিবন্ধিত দলিলের মাধ্যমে সম্পত্তি হস্তান্তর হয়ে গেলে, তা বাতিলের জন্য আদালতে জালিয়াতি বা প্রভাব বিস্তারের মতো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণ করতে হয়, যা সাধারণত বেশ কঠিন।
শেষ কথা: পিতা তার জীবদ্দশায় সম্পত্তির মালিক এবং তিনি আইন মেনে তা হস্তান্তর করতে পারেন। তবে সেই হস্তান্তর যদি আইনসম্মত না হয় বা অন্য সন্তানদের বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে কোনো বেআইনি কৌশল অবলম্বন করা হয়, তবে বঞ্চিতদের অধিকার আদায়ের জন্য আইনের দরজা সবসময় খোলা।