বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই ভারসাম্যহীন অবস্থায় রয়েছে।
বিগত বছরগুলোয়, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের শাসনামলে এই দুই দেশের মধ্যে যে বাণিজ্য পরিস্থিতি ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেই ধারাবাহিকতাই এখনো চলছে, ঘাটতি রয়ে গেছে বাংলাদেশের পক্ষেই।
তবে সম্প্রতি পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খানের ঢাকা সফরকে ঘিরে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কের সম্ভাবনা ও সংকটের জায়গাগুলো আলোচনায় উঠে এসেছে।
পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী গত বুধবার চার দিনের সফরে ঢাকায় এসে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান, খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
এসব বৈঠকে দুই দেশের বাণিজ্য, শিল্প, খাদ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা জোরদারের নানা দিক উঠে এসেছে।
আলোচনায় দীর্ঘদিন অচল থাকা যৌথ অর্থনৈতিক কমিশন (জেইসি) পুনরায় চালু, নতুন বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন প্রতিষ্ঠা, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে নতুন খাত সংযোজন, শুল্ক ও অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহার, যৌথ বিনিয়োগ এবং সরাসরি পরিবহন সংযোগ চালুর মতো বিষয় উঠে আসে।
বিশ্লেষকদের মতে, এ আলোচনার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দেড় দশক পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক কিছুটা পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যদিও দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতিকে বড় করে দেখছেন তারা।
ঘাটতির চিত্র
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বরাত দিয়ে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বলা আছে, ২০২৩ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশে ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের বেশি অংকের পণ্য রফতানি করেছে। আর এ সময় বাংলাদেশ থেকে তারা আমদানি করেছে ৬৩ মিলিয়ন ডলারের পণ্য।
ব্যাংলাদেশের ব্যবসায়িক সংগঠন চিটাগাং চেম্বারের প্রশাসক মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা শুক্রবার একটি অনুষ্ঠানে বলেন, দু'দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য সম্পর্ক থাকলেও পাকিস্তান থেকে ৭০০ মিলিয়ন ডলারের অধিক আমদানির বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি মাত্র ৫৮ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টি স্পষ্ট। ফলে বাংলাদেশ–পাকিস্তান বাণিজ্য সম্পর্ককে "খুব বড় সম্ভাবনাময়" মনে করছেন না অর্থনীতিবিদ ড. গোলাম মোয়াজ্জেম।
বরং দুই দেশের রপ্তানি পণ্যের ধরন কাছাকাছি হওয়ায় এটি বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেও তিনি মনে করেন।
"পাকিস্তানও গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, প্রসেসড ফুড উৎপাদন করে। কাছাকাছি পণ্য হওয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানির সম্ভাবনা সীমিত," বলেন মি. মোয়াজ্জেম।
পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের সংগঠন পাকিস্তান বিজনেস কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে যেসব পণ্য রফতানি হয় তার একটি বড় অংশই হলো সুতা। এছাড়া লবণ, সালফার, বিভিন্ন রকম পাথর ও সিমেন্ট, সবজি ও ফল, চামড়া, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ, রাসায়নিক দ্রব্য, রং জাতীয় পণ্য আসে।
আর বাংলাদেশ থেকে যেসব পণ্য পাকিস্তানে যায় তার মধ্যে রয়েছে পাট ও টেক্সটাইল পণ্য, কাগজ, মেডিক্যাল পণ্য।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বাণিজ্যে আরেকটি বড় সমস্যা হলো সরাসরি পরিবহন সংযোগের অভাব। পণ্য পরিবহনের জন্য শ্রীলঙ্কা বা সিঙ্গাপুরের মতো তৃতীয় দেশের বন্দরের ওপর নির্ভর করতে হয়, যা পরিবহন ব্যয় বাড়িয়ে দেয়।
ড. মোয়াজ্জেম বলছেন, "যেহেতু দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বন্দর সংযোগ নেই, সব পণ্য তৃতীয় দেশের মাধ্যমে আসে। এতে ব্যয় যেমন বাড়ে, তেমনি সময়ও বেশি লাগে। এসব দিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের জায়গা যে খুব বড় সেটা বলা যাবে না।"
তবে বাংলাদেশের খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খানের সঙ্গে বৈঠকে উল্লেখ করেন, পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে এখন সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রামে আসতে শুরু করেছে। তার মতে, এ ব্যবস্থায় আমদানি খরচ কিছুটা কমেছে এবং বাণিজ্য কার্যক্রম সহজ হয়েছে।
যদিও সামগ্রিকভাবে পরিবহন সংযোগ সীমিত থাকায় বড় পরিসরে বাণিজ্য বাড়াতে বাধা রয়েই গেছে।
এদিকে একই দিনে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত শেষে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, "বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয়ই রপ্তানির ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইলের ওপর নির্ভরশীল। তাই দুই দেশকেই রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণে জোর দেওয়া প্রয়োজন।"
সিমেন্ট, চিনি, জুতা, চামড়া প্রভৃতি খাতে পাকিস্তান বেশ ভালো করছে এবং বাংলাদেশ চাইলে পাকিস্তান থেকে এসব পণ্য আমদানি করতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
পাশাপাশি ওষুধ খাতে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা পাকিস্তানের জন্য বেশ কার্যকর হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
সম্ভাবনাময় খাতগুলো
বাংলাদেশ বিশ্বের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোর অন্যতম। আর পোশাক শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল, তুলা ও সুতার উৎস পাকিস্তান। ফলে পাকিস্তান থেকে এসব কাঁচামাল তুলনামূলকভাবে কম খরচে আসতে পারে বাংলাদেশে।
আবার পাকিস্তানের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের চাহিদা আছে। এই পারস্পরিক চাহিদা কাজে লাগানো গেলে বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, "পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের বড় সুবিধা হলো বাংলাদেশ বর্তমানে পাকিস্তান থেকে টেক্সটাইল, সুতা ইত্যাদি কাঁচামাল আমদানি করছে, যেগুলো আমাদের রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য প্রয়োজন।"
তবে পরিবহন সীমাবদ্ধতা এবং অভিন্ন রপ্তানি কাঠামোর কারণে বাংলাদেশ–পাকিস্তান বাণিজ্য সম্পর্কের সম্ভাবনা সীমিতই থেকে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিনিয়োগ সহযোগিতা ও নির্দিষ্ট কাঁচামাল খাতেই রয়েছে সম্ভাবনার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু।
এ নিয়ে ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, "এ মুহূর্তে সম্ভাবনার জায়গাটা মূলত কাঁচামাল আমদানির দিকেই সীমিত। কারণ দুই দেশের রপ্তানিমুখী পণ্য প্রায় কাছাকাছি। তবে বিনিয়োগে পাকিস্তান আগ্রহ দেখালে সেখানে বড় সুযোগ তৈরি হতে পারে।"
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশ প্রতিবছর ৮০ বিলিয়ন ডলার আমদানি করে, যার মধ্যে ১৫ বিলিয়ন ডলারের খাদ্য ও মধ্যবর্তী পণ্য। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে এসব পণ্য বাণিজ্য বাড়ানোর সুযোগ আছে। আর সেটা খতিয়ে দেখার জন্য যৌথ অর্থনৈতিক কমিশন বা জেইসি গঠন করা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন ও বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খানের বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের ওপর পাকিস্তানের আরোপিত অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়েও আলোচনায় হয়। এ বিষয়ে পাকিস্তান ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে বলে জানান বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা।
দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ব্যবধান কমাতে আগের মতো পাকিস্তানে এক কোটি কেজি চা শুল্ক ও কোটামুক্ত রপ্তানি এবং আনারসসহ বিভিন্ন ফল রপ্তানির সুযোগ চেয়েছে বাংলাদেশ।
সেইসাথে পাকিস্তানের চামড়া ও চিনি শিল্প নিয়েও আলোচনা করার কথা জানান তিনি। কারণ এই দুই শিল্পে পাকিস্তান বেশ এগিয়ে রয়েছে।
একই দিনে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের সঙ্গে বৈঠক করেন জাম কামাল খান। বৈঠকে শিল্প উন্নয়নের ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি ও পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।
এরইমধ্যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের চিনি শিল্পের উন্নয়নে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা বৈঠকে জানানো হয়।
এ সময় পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী দুই দেশের শিল্পের উন্নয়ন, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাকিস্তানের আগ্রহের কথা জানান।
তবে বাংলাদেশের বাণিজ্য সচিবে মাহবুবুর রহমানের ভাষায়, "পাকিস্তান থেকে আমরা বেশি আমদানি করি, আর কম রপ্তানি করি। এই ব্যবধান যদি কমানো যায়, সেটি বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে।"
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক শীতল হয়ে আসে। বরং সব দিক থেকেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়তে থাকে।
তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে এক ধরনের শীতলতা তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েন তৈরি হওয়ায় বাংলাদেশ বিকল্প সম্পর্ক জোরদার করতে চাইছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
ফলে বাংলাদেশ–পাকিস্তান বাণিজ্য দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা ও ভারসাম্যহীনতার মধ্যে আটকে থাকলেও সাম্প্রতি প্রেক্ষাপটে আলোচনায় নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বেলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।
এ বিষয়ে ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, "আমাদের একমুখী সম্পর্ক গড়া উচিত নয়। প্রতিটি সহযোগীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সীমারেখায়, যেখানে রপ্তানি ও আমদানির স্বার্থই অগ্রাধিকার পাবে।"