শিরোনাম
◈ গ্যাসসংকট: কমছে শিল্প উৎপাদন, প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে ◈ পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তৌহিদ হোসেনের ফোনালাপ, কী কথা হলো? ◈ ইউরোপীয় ইউনিয়নে অর্থের বিনিময়ে নাগরিকত্বের সুযোগ শেষ ◈ দেশের পথে খালেদা জিয়া ◈ টানা দুই দফা কমার পর আবারও বাড়লো স্বর্ণের দাম, ভরি কত? ◈ আদানি পাওয়ারের কাছে বাংলাদেশের বকেয়া প্রায় ৯০ কোটি ডলার! ◈ তথ্য-উপাত্ত সঠিক না থাকায় ফ্যাসাদ তৈরি হচ্ছে : বাণিজ্য উপদেষ্টা ◈ চিকিৎসা ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ ছাড়া সমস্যা নিরসন হবে না: প্রধান উপদেষ্টা ◈ বাতাসের মান যাচাইয়ে রাজধানীর ২৫ যায়গায় বসবে আধুনিক যন্ত্র: ডিএনসিসি   ◈ অবৈধ অভিবাসন বন্ধে বাংলাদেশকে সহযোগিতার প্রস্তাব ইতালির, আরও লোক নিতে আগ্রহী

প্রকাশিত : ০৬ মে, ২০২৫, ১২:৩৭ রাত
আপডেট : ০৬ মে, ২০২৫, ০৩:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

কলাবাগানের সেই বাসায় কী ঘটেছিল?

২৯শে এপ্রিল রাত দেড়টা। কলাবাগান থানা এলাকার সোনারগাঁও রোডের ২২/২ নম্বর বাড়ি। তখন রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ড. আব্দুল ওয়াদুদ। এরমধ্যে কলাবাগান থানার সাব-ইন্সপেক্টর বেলালের নেতৃত্বে একদল পুলিশ সদস্য ও ২০/২৫ জনের একদল সন্ত্রাসী তার বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর চালাতে থাকে। বাড়ির নিচে থাকা বিদেশি পাখি, হরিণসহ সবকিছু লুটপাট শুরু করে। তছনছ করে দেয়া হয় পুরো বাড়ি। আর একদল লোক বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তাদের পাহারা দিচ্ছিলো। অবস্থা বেগতিক দেখে বাড়ির ম্যানেজারকে জাতীয় জরুরি সেবা-৯৯৯ এ ফোন করতে বলেন তিনি। ফোন করার কিছুক্ষণের মধ্যেই শাহবাগ ও নিউমার্কেট থানার দু’টি টহল টিমের গাড়ি এসে বাড়ির সামনের মেইন রাস্তায় থামে। তখন ম্যানেজার দেখেন- আগে থেকে দাঁড়িয়ে থাকা কলাবাগান থানার ওসি নিউমার্কেট ও শাহবাগ থানার টহল টিমকে চলে যেতে বলছেন। আর শাহবাগ ও নিউমার্কেট থানায় সংবাদ দেয়ার জন্য বাড়িটির ভাড়াটিয়া ষাটোর্ধ্ব লাল মিয়া ও নাইটগার্ড লুৎফরকে গালিগালাজ করে কলাবাগান থানায় তুলে নিতে পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দিচ্ছেন ওসি মোক্তারুজ্জামান। ওইদিনের ঘটনায় কলাবাগান থানার ওসি ও দুই এসআইকে ক্লোজড করা হয়েছে। ড. ওয়াদুদের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পেয়েছে পুলিশ। 

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ড. ওয়াদুদ বলেন, যখন রাস্তায় এমন কাণ্ড চলছে তখন বাড়ির মধ্যে থাকা কলাবাগান থানার এসআই বেলালের নেতৃত্বে একদল পুলিশ সদস্য তৃতীয় তালার ঘরের দরজা ভাঙার চেষ্টা করছেন। আমি তখনো ঘরের মধ্যে। আমার একটা দরজা ভাঙতেই তাদের ২ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। গভীর রাতে সন্ত্রাসী ও পুলিশের এমন তাণ্ডব ও দরজা ভাঙার শব্দে পুরো এলাকায় তখন এক ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। ভয়ে আমার ৯০ বছরের বৃদ্ধ মা ও স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। 

তিনি বলেন, কোনোভাবেই ওই পুলিশ সদস্যরা কথা শুনছিলেন না। তারা যা খুশি তাই করছিলেন। আমার বাসার একটি দরজা ভাঙার পর দ্বিতীয় দরজা যখন ভাঙার চেষ্টা চলছিল তখন আমি কলাবাগান থানার ওসিকে সাহায্যের জন্য মোবাইল ফোনে কল করি। তিনি আমাকে তখন বলেন- আপনি দরজা আটকে রেখেছেন কেন। দরজা খুলে দেন। আপনার সহযোগিতা করতে পুলিশ এসেছে। আপনি পুলিশের সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসুন। আপনার বাড়িতে ডিবি’র লোক অভিযান চালাচ্ছে তাদের সহযোগিতা করুন। তখন আমি কোনো উপায় না দেখে পুলিশের সঙ্গে থানায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং দরজা খুলে দেই। কিন্তু দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে এসআই বেলাল ও মান্নান আমাকে ধাক্কা মেরে ঘরের ভেতরে আমাকে টেনে নিয়ে গালিগালাজ করতে থাকেন। তারা বাসার মধ্যে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করেন ও কী যেন খুঁজতে থাকেন। আর আমাকে বারবার উগ্রভাবে জিজ্ঞেস করেন আমার কাছে কী কী অস্ত্র আছে? কিন্তু আমি তাদের বলি- আমার কাছে অস্ত্র কোথা থেকে আসবে! আমি অস্ত্র কোথায় পাবো। ওসি আমাকে থানায় যেতে বলেছেন- চলেন আমরা থানায় যাই। এরইমধ্যে মান্নান নামের একজন পুলিশ সদস্য আমাকে একটু আড়ালে নিয়ে বলেন- এই মুহূর্তে এক কোটি টাকা দিতে পারলে আমাকে থানায় যেতে হবে না। তারা আমাকে বাড়িতে রেখে যাবে। তখন আমি তাকে চাপা স্বরে বলি- আমার নামে কী মামলা হয়েছে? তখন তারা আমাকে জানায়- আপনার নামে কোনো মামলা হয়নি, আমরা টাকার জন্য এসেছি। যদি টাকা না দেই তাহলে আমার বিরুদ্ধে ১টা না ১০টা মামলা হবে। অনেক দেনদরবার করার পর আমি উপায় না পেয়ে দুই লাখ টাকা পুলিশ সদস্য বেলাল ও মান্নানের হাতে তুলে দিয়ে বলি, আমার বাসায় তো এত টাকা নেই। ব্যাংক থেকে আমাকে তুলে তারপর দিতে হবে। আপনারা একটু ওসিকে বুঝিয়ে বলেন। এরপর তারা আমাকে শর্ত দেয়- পরদিন বুধবার ব্যাংকিং আওয়ারের মধ্যে বাকি টাকা দিতে হবে। কিন্তু টাকা না দেয়া পর্যন্ত বাড়িতে ৩ জন ডিবি পুলিশ সিভিল ড্রেসে পাহারা দিবে। ড. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, তারা রাত দেড়টায় আমার বাড়িতে ঢুকেছে আর পরদিন সকাল সাড়ে ৭টায় বাড়ি থেকে বের হয়েছে। সারা রাত ধরে তারা আমার বাড়িতে তাণ্ডব চালিয়েছে। সকালে যখন পাহারায় থাকা ৩ জন সাদা পোশাকের পুলিশ চলে যান তখন এসআই বেলাল আমার বাড়িতে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি এরকম একটা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি জোরপূর্বক আমার কাছ থেকে আদায় করেন। যার সম্পূর্ণটা তারা তাদের মোবাইলে ভিডিও করে রাখেন। শুধু তাই নয়, রাতে তাদের তাণ্ডবের চিত্র যেনো জনসম্মুখে না আসে এই জন্য তারা যাওয়ার সময় আমার বাসার কম্পিউটারের সিপিইউ, ল্যাপটপ, সিসি ক্যামেরার হার্ডডিক্স সব তাদের সঙ্গে নিয়ে যায়।

বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সমিতির এই প্রধান পৃষ্ঠপোষক ড. ওয়াদুদ বলেন, ২০০৬ সালে আমি আমার বাড়িতে একটি মিনি চিড়িয়াখানা তৈরি করি। যার সরকারি লাইসেন্সও আমার কাছে রয়েছে। সেখানে আমি হরিণ, বিদেশি ম্যাকাও,  কাকাতুয়া, ইলেকট্রিক, রেইনবো লরিসহ বিদেশি দুর্লভ ও অনেক মূল্যবান পাখি পালন করি। যা নিয়ে অনেক দেশি-বিদেশি পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিও হয়েছে। আমি সেদিন আমার বাসার নিচে নেমে দেখি  পাখিগুলো সব তারা লুট করে নিয়ে গেছে। প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার মতো প্রাণী তারা নিয়ে গেছে। আর গভীর রাতে দরজা ভাঙার উচ্চ শব্দে হরিণগুলো ছোটাছুটি করায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে একটি গর্ভবতী হরিণও মারা যায়। বাকি হরিণগুলোর মুখ দিয়েও রক্ত ঝরছিল। তারা যাওয়ার পরও যখন ৩ জন সাদা পোশাকে পুলিশ আমার বাড়ির পাহারায় ছিলেন তখন ৩০শে এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে তাদের ফাঁকি দিয়ে আমি বাসা থেকে বের হয়ে আসি। বাসা থেকে বের হয়েই আমি সোজা চলে যাই আমাদের এলাকা থেকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের এমপি প্রার্থীর বাসায়। আমি তার বাসায় যাওয়ার আগেই তিনি পেশায় ব্যারিস্টার হওয়ায় আদালতের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যান। আমিও তখন হাইকোর্টে তার চেম্বরে গিয়ে উপস্থিত হই। ঘণ্টা দু’য়েক অপেক্ষার পর তার দেখা পাই। তাকে সব খুলে বলি। এলাকায় রাজনীতি করায় তিনি আমার বাসায় পুলিশের সঙ্গে হামলা করা সকলকেই চিনতেন। তিনি তখন দু’জন স্থানীয় নেতাকে ফোন করে বলেন- ওয়াদুদ ভাই আমার বড় ভাই। তার ঘরে আমি থাকছি। তোমরা এখনই বাসা থেকে সকলকে বের হতে বলো। এর কিছুক্ষণ পর আমি বাসায় ফোন দিয়ে জানতে পারি তারা সকলে চলে গেছেন। এরপর আমি বাসায় যাই। এর পরদিন ১লা মে কলাবাগান থানা থেকে ওসি আমার ল্যাপটপটি ফেরত পাঠায়।  তবে বাকি কোনোকিছুই আমি এখানো ফেরত পাইনি। উল্টো তাদের দাবিকৃত সেই টাকার জন্য আমাকে বারবার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। অপরিচিত লোকজন বাড়ির আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে। জীবন শঙ্কায় আমি বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হই। এরপর আমি  ২রা মে সিদ্ধান্ত নিই পুলিশসহ বাকি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করবো। কিন্তু ভেবে দেখলাম যেই ওসি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আমার বাড়িতে এই তাণ্ডব চালিয়েছে, সেই আমার অভিযোগের প্রেক্ষিতে কি ব্যবস্থা নিবেন। এরপর আমি গত রোববার ৪ঠা মে সকালে ডিএমপি কমিশনার বরাবর একটি অভিযোগ দেই। সেদিন বিকালেই কমিশনারের পক্ষ থেকে বার্তা আসে- ওই ওসিসহ দুই এসআইকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমি খোঁজ নিয়েছি এই ওসি কলাবাগান এলাকায় আরও অনেকের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা আগে খোঁজ নেয় কে ধনাঢ্য ব্যক্তি। কে কে টাকার মালিক। তাদেরই টার্গেট করে ওসি। 

এ বিষয়ে কলাবাগান থানার বর্তমান ওসি’র দায়িত্ব পালন করা পরিদর্শক (তদন্ত) রফিকুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, ওসি মোক্তারুজ্জামান আমাদের সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেছেন। তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। 

বিষয়টি নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, কলাবাগান থানার ওসি’র চাঁদাবাজি, অর্থ আদায়, ভাঙচুর, লুটপাট ও মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর হুমকির অভিযোগের সঠিক তদন্ত ও যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ডিএমপি কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন ড. আব্দুল ওয়াদুদ। ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ডিএমপি’র সদর দপ্তর। অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রথমে কলাবাগান থানার ওসি মোক্তারুজ্জামানকে প্রত্যাহার করা হয়। পরে ওই থানার এসআই বেলাল ও এসআই মান্নানকেও প্রত্যাহার করে রমনা বিভাগে সংযুক্ত করা হয়। এরপর ডিএমপি থেকে তাদের ৩ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

এ বিষয়ে ডিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) এস এন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, গত ২৯শে এপ্রিল কলাবাগানের একটি বাসায় ‘মবের’ ঘটনা ঘটেছিল। সেটা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় রোববার সংশ্লিষ্ট কলাবাগান থানার ওসি মোক্তারুজ্জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করেছেন ঢাকা ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাদ আলী। উৎস: মানবজমিন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়