শিরোনাম
◈ অন্তর্বর্তী সরকারের আহ্বানে সাড়া? বিএনপি–জামায়াতের মধ্যে আলোচনা উদ্যোগ ◈ আজ ঐতিহাসিক জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস ◈ ভয়ানক অভিযোগ জাহানারার, তোলপাড় ক্রিকেটাঙ্গন (ভিডিও) ◈ জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও সময়মতো জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিতের আহ্বান বিএনপির স্থায়ী কমিটির ◈ কমিশনের মোট ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৭১ লাখ টাকা, আপ্যায়ন বাবদ ব্যয়  ৪৫ লাখ টাকা ◈ ভার‌তের কা‌ছে পাত্তাই পে‌লো না অস্ট্রেলিয়া, ম‌্যাচ হার‌লো ৪২ রা‌নে ◈ শুল্ক চুক্তির অধীনে মা‌র্কিন উ‌ড়োজাহাজ নির্মাতা বোয়িংয়ের কাছ থেকে ২৫টি বিমান কিনছে বাংলাদেশ ◈ টিটিপাড়ায় ৬ লেনের আন্ডারপাস, গাড়ি চলাচল শুরু শিগগিরই (ভিডিও) ◈ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ বার্তা ◈ ভালোবাসার টানে মালিকের সঙ্গে ইতালি যাওয়া হলো না সেই বিড়াল ক্যান্ডির!

প্রকাশিত : ০৩ নভেম্বর, ২০২৫, ০৯:২৪ সকাল
আপডেট : ০৬ নভেম্বর, ২০২৫, ০২:০০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ইসলামে দারিদ্র্য দূরীকরণের দিকনির্দেশনা ও সমাধান

দারিদ্র্য মানুষের জীবনের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দারিদ্র্য যখন ঘিরে ধরে, তখন শুধু অর্থের অভাবে সীমিত থাকে না; বরং জীবনের মান, নিরাপত্তা ও সুযোগও নষ্ট করে ফেলে। কোরআনে এ সমস্যার উল্লেখ এসেছে বারবার।

যেমন সুরা কুরাইশে বলা হয়েছে, ‘কুরাইশের অভ্যাসের জন্য, শীত ও গ্রীষ্মের সফরের অভ্যাসের জন্য, তারা যেন এই ঘরের প্রভুর ইবাদত করে, যিনি তাদের ক্ষুধায় খাদ্য দিয়েছেন এবং ভয় থেকে নিরাপত্তা দিয়েছেন।’ (সুরা কুরাইশ, আয়াত: ১-৪)।

নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে সকালে নিরাপদে, সুস্থ শরীরে এবং দিনের খোরাকি নিয়ে জেগে ওঠে, তার জন্য যেন পুরো দুনিয়া দেওয়া হয়েছে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৪১২)

যদি জনপদের লোকেরা ইমান আনত ও তাকওয়া অবলম্বন করত, তবে আমরা তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবী থেকে বরকতের দ্বার খুলে দিতাম: সুরা আরাফ, আয়াত: ৯৬

ইসলামি ফিকহে দারিদ্র্যের সংজ্ঞা, এর মাত্রা এবং সমাধান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। এ লেখায় আমরা ইসলামে দারিদ্র্য দূরীকরণের উপায়গুলো সহজ ভাষায় তুলে ধরব।

দারিদ্র্য কী

দারিদ্র্যের সংজ্ঞা দেশ ও অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে ভিন্ন হয়। সবচেয়ে কঠিন রূপ হলো চরম দারিদ্র্য, যখন মানুষের পেট ভরার মতো খাবারও থাকে না। এমন পরিস্থিতিতে নবীজি (সা.) ভিক্ষা করার পর্যন্ত অনুমতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভিক্ষা জায়েজ তিন ধরনের মানুষের জন্য—চরম দরিদ্র, প্রচণ্ড ঋণগ্রস্ত ও গুরুতর রক্তপণে আক্রান্ত ব্যক্তি।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ১,৬৪০)

মালিকি, শাফিঈ ও হাম্বলি ফকিহরা বলেন, দারিদ্র্য মানে মৌলিক চাহিদা পূরণের অভাব, যেমন খাদ্য, বাসস্থান ও পোশাক। কোরআনে দারিদ্র্যের দুটি রূপের কথা বলা হয়েছে—বর্তমানে বিদ্যমান দারিদ্র্য, ‘তোমরা দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না, আমরা তোমাদের ও তাদের জন্য রিজিক দেব।’ (সুরা ফুসসিলাত, আয়াত: ১৫১)

এবং ভবিষ্যতের দারিদ্র্যের ভয়, ‘তোমরা দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না, আমরা তাদের ও তোমাদের জন্য রিজিক দেব।’ (সুরা ইসরা, আয়াত: ৩১)

দারিদ্র্যের একটি আধ্যাত্মিক কারণ হলো হালাল উপার্জন থেকে বিচ্যুতি। কোরআন বলে, ‘যদি জনপদের লোকেরা ইমান আনত ও তাকওয়া অবলম্বন করত, তবে আমরা তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবী থেকে বরকতের দ্বার খুলে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যারোপ করল, তাই আমরা তাদের কৃতকর্মের জন্য পাকড়াও করেছি।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৯৬)

এ ছাড়া দারিদ্র্য একটি পরীক্ষাও, ‘আমরা অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা, সম্পদের ক্ষতি, জীবন ও ফসলের ক্ষতি দিয়ে। আর ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫)

জীবনযাত্রার মান হ্রাসের মাত্রা

জীবনযাত্রার মান কমে যাওয়ার দুটি প্রধান কারণ হলো বেকারত্ব ও দারিদ্র্য। বেকারত্ব দুই ধরনের:

বাধ্যতামূলক বেকারত্ব: যখন কেউ কাজ করতে চায়, কিন্তু পায় না। যেমন তার পেশা অপ্রচলিত হয়ে যাওয়া বা দক্ষতার অভাব।

স্বেচ্ছা বেকারত্ব: যখন কেউ কাজ করতে পারে, কিন্তু বিশ্রাম নিতে চায়।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাধারণত জীবনযাত্রার মান বাড়ায়। কিন্তু প্রবৃদ্ধি হলেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন না হলে মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি হয় না। তাই প্রবৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্য দূরীকরণের নীতি জরুরি। শুধু বিনিয়োগ বা রপ্তানি বাড়ালেই হবে না, সম্পদ ও আয়ের ন্যায্য বণ্টন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ এবং দরিদ্রদের জন্য সরাসরি সহায়তা দরকার।

অর্থনৈতিক মন্দা ও মূল্যস্ফীতির প্রভাব

দারিদ্র্য ও দারিদ্র্যের অনুভূতি এক নয়। মূল্যস্ফীতি বা মুদ্রার মান কমে গেলে অর্থনৈতিক মন্দা তৈরি হয়। ফলে পণ্য ও সেবার চাহিদা কমে, উৎপাদন খরচ বাড়ে, উৎপাদন কমে, শ্রমিকদের আয় কমে এবং দাম আরও বাড়ে। এই দুষ্টচক্র মানুষের মধ্যে দারিদ্র্যের অনুভূতি বাড়ায়।

হে আদম সন্তান, রিজিকের সংকীর্ণতার ভয় করো না, আমার ভান্ডার পূর্ণ, কখনো শেষ হবে না: মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২২,৪৬৫

অর্থনীতিবিদেরা বলেন, দারিদ্র্য সমাজের আইনি সম্পর্কে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ায়। তাই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে ন্যায্য বণ্টন ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।

ইসলামে দারিদ্র্য দূর করার উপায়

ইসলাম দারিদ্র্য দূরীকরণে দুটি প্রধান দিক নির্দেশ করে—আকিদা (বিশ্বাস) ও কারণ গ্রহণ।

এক. আকিদার দিক

ইসলাম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আধ্যাত্মিক শক্তি দেয়। এর চারটি মূল দিক:

পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাখ্যান: ইসলাম বলে, সম্পদ আল্লাহর, মানুষ এর তত্ত্বাবধায়ক। ‘তোমরা তা থেকে ব্যয় করো, যাতে তিনি তোমাদের তত্ত্বাবধায়ক করেছেন।’ (সুরা হাদিদ, আয়াত: ৭)

‘আল্লাহর দেওয়া সম্পদ থেকে তাদের দাও।’ (সুরা নুর, আয়াত: ৩৩)।

রিজিকের উৎসে বিশ্বাস: আল্লাহই রিজিকের মালিক। ‘আকাশে তোমাদের রিজিক ও যা প্রতিশ্রুত আছে। আকাশ ও পৃথিবীর প্রভুর কসম, এটি সত্য, যেমন তোমরা কথা বল।’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত: ২২-২৩)

হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, ‘হে আদম সন্তান, রিজিকের সংকীর্ণতার ভয় করো না, আমার ভান্ডার পূর্ণ, কখনো শেষ হবে না।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২২,৪৬৫)।

দোয়া ও ইস্তিগফার: ক্ষমা প্রার্থনা রিজিক বাড়ায়। ‘আমি বললাম, তোমরা তোমাদের প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, তিনি মহা ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের প্রচুর বৃষ্টি পাঠাবেন, সম্পদ ও সন্তান দিয়ে সাহায্য করবেন এবং বাগান ও নদী দেবেন।’ (সুরা নুহ, আয়াত: ১০-১২)

ইমান ও তাকওয়া: আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও তাকওয়া রিজিকের পথ খুলে। নবীজি (সা.) দারিদ্র্য ও কুফর থেকে আশ্রয় চেয়েছেন, ‘হে আল্লাহ, আমি কুফর ও দারিদ্র্য থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ১৫৪৪)

দারিদ্র্য কখনো কখনো কুফরের দিকে নিয়ে যায়, তাই শক্তিশালী ইমান জরুরি।

দুই. ব্যবহারিক উপায়

ইসলাম দারিদ্র্য দূরীকরণে ৮টি ব্যবহারিক উপায়ের কথা বলে:

১. কঠোর পরিশ্রম: কাজ করা ও জীবিকার জন্য পৃথিবীতে চলাফেরা। ‘তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে সহজ করেছেন। তাই এর বিস্তৃত পথে চলো এবং তাঁর রিজিক থেকে খাও’ (সুরা মুলক, আয়াত: ১৫)।

২. হিজরত: ভালো জীবিকার জন্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া। নবীজি (সা.) ও সাহাবারা মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেছিলেন।

৩. প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার: আল্লাহর দেওয়া সম্পদের সঠিক ব্যবহার। ‘তিনি পৃথিবীতে যা আছে সব তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৯)।

৪. সাশ্রয়ী ব্যয়: অপচয় এড়ানো। ‘খাও, পান করো, কিন্তু অপচয় করো না’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৩১)।

৫. সঞ্চয় ও বিনিয়োগ: সম্পদ সংরক্ষণ ও উৎপাদনমূলক কাজে লাগানো।

৬. হালাল উপার্জন: রিবা, প্রতারণা, জুয়া বা শ্রমিকদের বঞ্চনার মাধ্যমে উপার্জন নিষিদ্ধ। ‘তোমাদের জন্য হালাল ও পবিত্র জিনিস খাও’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৭২)।

৭. জাকাত ও সাদকা: জাকাত সম্পদের ২ দশমিক ৫ থেকে ৫ শতাংশ হারে দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। নবীজি (সা.) মুয়াজ ইবনে জাবালকে ইয়েমেনে পাঠিয়ে বলেছিলেন, ‘ধনীদের কাছ থেকে জাকাত নাও এবং তা দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করো’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৪৭২)। জাকাত সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য কমায়।

৮. আত্মীয়দের সহায়তা: ধনী আত্মীয়দের দরিদ্র আত্মীয়দের সাহায্য করতে হয়। ‘তোমরা নিকটাত্মীয়কে তার প্রাপ্য দাও, দরিদ্র ও মুসাফিরকেও’ (সুরা ইসরা, আয়াত: ২৬)।

প্রবৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্য দূরীকরণের নীতি জরুরি। শুধু বিনিয়োগ বা রপ্তানি বাড়ালেই হবে না, সম্পদ ও আয়ের ন্যায্য বণ্টন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ এবং দরিদ্রদের জন্য সরাসরি সহায়তা দরকার।

সমাজে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি

ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুঁজিবাদের চেয়ে মানবিক। এটি শুধু কাজের মাধ্যমে সম্পদ অর্জনকে বৈধ বলে। কারণ, পুঁজি নিজে থেকে আয়ের উৎস নয়। জাকাত ও ওয়াক্‌ফের মতো ব্যবস্থা সম্পদের ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করে। ওয়াক্‌ফ ইতিহাসে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও দরিদ্রদের সহায়তায় বড় ভূমিকা রেখেছে। রাষ্ট্রও প্রয়োজনে সম্পদ জাতীয়করণ বা কর আরোপ করতে পারে সামাজিক কল্যাণের জন্য, যেমন স্বাস্থ্য বা শিক্ষার জন্য।

দারিদ্র্য ও বেকারত্ব একে অপরের সঙ্গে জড়িত। ইসলাম কাজের প্রতি উৎসাহ দেয়, মানুষের দক্ষতা বাড়ায় এবং সমাজের বৈষম্য কমায়। দারিদ্র্য কেবল অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি অত্যাচার, অজ্ঞতা ও রোগের সঙ্গে যুক্ত। তাই ইসলামি সমাজে দারিদ্র্য দূরীকরণ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়।

ইসলাম দারিদ্র্য দূরীকরণে আধ্যাত্মিক ও ব্যবহারিক পথ দেখায়। আকিদা মানুষকে আশা দেয়, আর কারণ গ্রহণ তাকে কাজে উদ্বুদ্ধ করে। জাকাত, সাদকা ও ওয়াক্‌ফের মতো ব্যবস্থা সমাজে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে। ইসলাম শুধু দারিদ্র্য দূর করে না; বরং প্রত্যেকের জন্য মর্যাদাপূর্ণ জীবনের পথ তৈরি করে।

সূত্র: প্রথম আলো 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়