ইকোনমিস্টের রিপোর্ট: গত বছরের শেষ দিকে একটি মার্কিন ও একটি ফরাসি সামরিক স্যাটেলাইট শত্রু স্যাটেলাইটের কাছাকাছি কক্ষপথে এক সূক্ষ্ম কৌশলগত মহড়ার প্রস্তুতি নেয়। এটি ছিল তথাকথিত ‘রঁদেভু ও প্রক্সিমিটি অপারেশন’ (আরপিও)- যেখানে একটি বা একাধিক স্যাটেলাইট অন্য একটি স্যাটেলাইটের কাছে গিয়ে সেটিকে পর্যবেক্ষণ বা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। কোন শত্রু স্যাটেলাইটকে কেন্দ্র করে এটি হয়েছিল, তা প্রকাশ করা হয়নি।
তবে অনুমান করা কঠিন নয়। কলোরাডো স্প্রিংসে মার্কিন স্পেস কমান্ডের সদর দফতরে জেনারেল স্টিফেন হুইটিং বলেন, ফরাসিরা বছরের পর বছর ধরে রাশিয়ার ফরাসি স্যাটেলাইটের কাছাকাছি পরিচালনা নিয়ে কথা বলেছে। তাই আমরা দেখিয়ে দিয়েছি যে, আমরা একে অপরের স্যাটেলাইট এবং অন্যান্য দেশের স্যাটেলাইটের কাছাকাছি এমনভাবে পরিচালনা করতে পারি, যা আমাদের যৌথভাবে কাজ করার ক্ষমতা প্রদর্শন করে।
তিনি জানান, এই মহড়া এতটাই সফল ছিল যে, এ বছর পরে আরেকটি মহড়ার পরিকল্পনা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো ফাইভ আইজ জোটের বাইরে কোনো দেশের সঙ্গে এই ধরনের পর্যবেক্ষণ চালায়। প্রথমবারের মতো এটি পূর্বপরিকল্পিত সামরিক উদ্দেশ্যে, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়। এটি যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশে আরও আক্রমণাত্মক কৌশলের প্রতীকও বটে। ২০১৯ সালে ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে পুনর্গঠিত হয় স্পেস কমান্ড। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি সদর দফতর গঠন ও জনবল তৈরিতে মনোনিবেশ করেছে। এখন এটি প্রস্তুত।
জেনারেল হুইটিং বলেন, আমাদের এখন একটি যোদ্ধা কমান্ড রয়েছে, যা মহাকাশে যুদ্ধের জন্য নিবেদিত। এর পেছনে দুটি বড় কারণ রয়েছে। প্রথমত, মার্কিন সেনাবাহিনীর স্যাটেলাইট নির্ভরতা ‘গুণোত্তর হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে এক কর্মকর্তা জানান। তিনি ইঙ্গিত দেন ২০২৩ সালের জুনে ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার দিকে। সেই অভিযানের বেশিরভাগই মহাকাশ-নির্ভর। দ্বিতীয়ত, হুমকির চরিত্রে পরিবর্তন। ২০১৫ সালের পর থেকে চীনের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের হার আটগুণ বেড়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
পিপলস লিবারেশন আর্মি এখন মহাকাশে আরও দক্ষ, এমনকি কক্ষপথে ইলেকট্রনিক যুদ্ধ পরিচালনায়ও পারদর্শী। চীন এ ক্ষেত্রে রাশিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে। চীন, রাশিয়া ও ভারত যথাক্রমে ২০০৭, ২০২১ ও ২০২২ সালে ধ্বংসাত্মক অ্যান্টি-স্যাটেলাইট অস্ত্র পরীক্ষা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র আরও অভিযোগ করছে, রাশিয়া এমন একটি কক্ষপথীয় পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে, যা একসাথে নিম্ন-কক্ষপথে হাজারো স্যাটেলাইট ধ্বংস করতে সক্ষম। কয়েক বছর আগেও স্পেস কমান্ড নিজেদের আক্রমণাত্মক সক্ষমতা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে দ্বিধা করত। এখন তারা তা গ্রহণ করেছে।
গত এপ্রিলে জেনারেল হুইটিং বলেন, এখন সময় এসেছে স্পষ্টভাবে বলার যে আমাদের মহাকাশে আক্রমণ ক্ষমতা দরকার, অস্ত্র ব্যবস্থা দরকার, কক্ষপথে ইন্টারসেপ্টর দরকার। এগুলোকে আমরা কী বলি? আমরা এগুলোকে বলি অস্ত্র। তিনি ট্রাম্পের ‘গোল্ডেন ডোম’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার দিকে ইঙ্গিত করেন, যেখানে শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে মহাকাশ-ভিত্তিক ইন্টারসেপ্টর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। একই অস্ত্র তাত্ত্বিকভাবে শত্রু স্যাটেলাইটকেও লক্ষ্যবস্তু করতে পারে। ‘স্পেস-টু-স্পেস, স্পেস-টু-গ্রাউন্ড, গ্রাউন্ড-টু-স্পেস- সব মিলিয়ে প্রতিরোধ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ঘাতক ক্ষমতা আনতে হবে’। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররাও এ বিষয়ে আরও স্পষ্ট হচ্ছে।
এ বছরের প্রতিরক্ষা পর্যালোচনায় বৃটেন প্রথমবারের মতো ঘোষণা করেছে যে, তারা পৃথিবী ও কক্ষপথে মোতায়েনযোগ্য অ্যান্টি-স্যাটেলাইট অস্ত্র তৈরি করবে। যুক্তরাষ্ট্র অল্প কিছু মহাকাশ সক্ষম মিত্রকে নিয়ে একটি ঘনিষ্ঠ জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছে। অপারেশন অলিম্পিক ডিফেন্ডারের অধীনে, স্পেস কমান্ড ছয়টি দেশ- অস্ট্রেলিয়া, বৃটেন, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি এবং নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে কাজ করে ‘মহাকাশে শত্রুতামূলক কর্মকাণ্ড নিরস্ত্র করতে।’ এপ্রিলে এই উদ্যোগ প্রাথমিক কার্যকর সক্ষমতা অর্জন করেছে, সাতটি দেশই একটি যৌথ অভিযানের পরিকল্পনায় স্বাক্ষর করেছে, যার বিস্তারিত এ গ্রীষ্মে চূড়ান্ত হবে।
স্পেস কমান্ড যুদ্ধের কৌশলগত চাহিদা নিয়েও ভাবছে। জেনারেল হুইটিং বলেন, মহাকাশে সবকিছু নড়ছে। তবুও আমেরিকা তাদের স্যাটেলাইটগুলোকে ‘স্থির দুর্গ’ হিসেবে ভেবেছে। কারণ স্যাটেলাইট সরাতে জ্বালানি লাগে, যা এর আয়ুষ্কাল কমিয়ে দেয়। এর তিনটি সমাধান আছে। এক, স্যাটেলাইটে বেশি জ্বালানি বহন করা। দুই, কক্ষপথে জ্বালানি পুনঃপূর্ণ করা- যা চীন গত জুনে প্রদর্শন করেছে। এটি তাদের সামরিক সুবিধা দিতে পারে। তাই আমাদেরও সেই ক্ষমতা দরকার। তৃতীয় উপায় হলো এত বেশি সংখ্যক স্যাটেলাইট পরিচালনা করা যাতে প্রতিটি স্যাটেলাইটকে ব্যবহারযোগ্য হিসেবে ধরা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বহু বছর ধরে এই ধরনের নিম্ন-কক্ষপথ ‘বিস্তৃত নক্ষত্রমণ্ডল’- যেমন স্পেসএক্সের স্টারলিংক- নিয়ে আলোচনা করছেন। এখন সেগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল রিকনাইসেন্স অফিস, যা শ্রেণিবদ্ধ গুপ্তচর স্যাটেলাইট পরিচালনা করে, ২০২৩ সাল থেকে ২০০-রও বেশি উৎক্ষেপণ করেছে এবং শুধু এই বছরেই আরও ডজনখানেক উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা রয়েছে। স্পেসএক্সেরও গুজব রয়েছে যে তারা ৪৫০-সদস্যের একটি নক্ষত্রমণ্ডল তৈরি করতে এগিয়ে আছে, যা একসময় সেন্সর থেকে ইন্টারসেপ্টর ও অস্ত্র পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র-ট্র্যাকিং এবং অন্যান্য তথ্য রিলে করবে।
এর সঙ্গে আরও একটি পদ্ধতি যোগ হতে পারে: স্যাটেলাইটগুলোকে আরও বুদ্ধিমান করা। জেনারেল হুইটিং বলেন, তিনি চান স্যাটেলাইটে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই থাকুক, যাতে তা কাছাকাছি থাকা ‘অশুভ’ বস্তু শনাক্ত করতে পারে এবং মানব হস্তক্ষেপ ছাড়াই এড়িয়ে যেতে পারে। সময়ের সাথে সাথে, মার্কিন স্পেস ফোর্সের মেজর ক্রিস্টোফার হুইন প্রস্তাব করেন, এআই-সক্ষম স্যাটেলাইটগুলো ঘনিষ্ঠ বিন্যাসে উড়তে পারবে, ফলে তারা কক্ষপথে উচ্চমূল্যের সম্পদ রক্ষাকারী স্যাটেলাইট হিসেবে কাজ করতে পারবে।
এখনও এআই মূলত ভূমিতেই সীমাবদ্ধ। গত কয়েক মাসে জেনারেল হুইটিং জানান, তার কর্মীরা একটি বড় ভাষা মডেল তৈরি করেছে, যা কমান্ডের হুমকি ও পরিকল্পনার সব তথ্য দিয়ে প্রশিক্ষিত। কর্মকর্তারা স্পেসবট নামের এই এআই’কে প্রশ্ন করতে পারেন, জ্ঞানের ফাঁক পূরণ করতে বা মহাকাশে কাল্পনিক বা বাস্তব আক্রমণের প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা করতে। যেখানে আগে দশজনের পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগত। এখন তা যন্ত্রগত গতিতে সম্ভব- একটি মহাকাশ যুগের অর্জন। অনুবাদ: মানবজমিন