ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার সাম্প্রতিক উত্তেজনায় এবার ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে চরম সংবেদনশীল ইস্যু-ধর্মীয় উপাসনালয় ধ্বংসচেষ্টার অভিযোগ। ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরকে (গোল্ডেন টেম্পল) লক্ষ্য করে হামলা চালাতে চেয়েছিল পাকিস্তান। তবে এই দাবি ‘সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট’ বলে মঙ্গলবার (২০ মে) নাকচ করে দিয়েছে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
একদিন আগে সোমবার ভারতের সেনাবাহিনী একতরফা দাবি করে, তারা পাকিস্তানের দিক থেকে আসা একটি হামলা প্রতিহত করেছে, যার লক্ষ্য ছিল শিখ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম পবিত্র উপাসনালয় স্বর্ণমন্দির। ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু এবং সংবাদ সংস্থা এএনআই-র খবরে বলা হয়, পাকিস্তান নাকি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে এই হামলা চালাতে চেয়েছিল।
এমনকি স্বর্ণমন্দিরের নিরাপত্তার জন্য কর্তৃপক্ষকে অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতিও দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন এক জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা। তিনি এএনআই-কে বলেন, ‘আমরা আগে থেকেই অনুমান করেছিলাম তারা (পাকিস্তান) কী করতে পারে... তারা আমাদের ধর্মীয় স্থান ও বেসামরিক জনসাধারণকে লক্ষ্য করে বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে আগ্রহী।’ তবে মঙ্গলবার পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শফকাত আলী খান এক বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে বলেন, ‘আমরা জোর দিয়ে বলছি, স্বর্ণমন্দির লক্ষ্য করে পাকিস্তানের হামলাচেষ্টার অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমরা সব ধর্মীয় উপাসনালয়কে সর্বোচ্চ সম্মান করি এবং এমন একটি পবিত্র স্থানে হামলার কথা কল্পনাও করতে পারি না।’
সংবাদমাধ্যম দ্য ডনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তিনি পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, ‘৬ ও ৭ মে ভারতের পক্ষ থেকেই পাকিস্তানে একাধিক ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা চালানো হয়েছে। এই ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগ আসল ঘটনাগুলো থেকে মনোযোগ সরানোর কৌশলমাত্র,’ তিনি যোগ করেন।
পাকিস্তানের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, শিখ ধর্মাবলম্বীদের বহু পবিত্র স্থানের গর্বিত রক্ষণাবেক্ষণকারী হচ্ছে ইসলামাবাদ। প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার শিখ তীর্থযাত্রী পাকিস্তানে আসেন, বিশেষ করে তারা কারতারপুর করিডরের মাধ্যমে ভিসাবিহীন প্রবেশাধিকার উপভোগ করে থাকেন।
এছাড়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইল’ করার অভিযোগ নিয়েও মুখপাত্র বলেন, ‘এই ধরনের গল্প সাজানো হচ্ছে ভারতের পক্ষ থেকে একটি বিভ্রান্তিকর বর্ণনা প্রচারের লক্ষ্যে।’
বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয়কে সংঘাতে টেনে আনা শুধু উত্তেজনাই বাড়াবে না, বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধার পরিবেশকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ধর্মীয় উপাসনালয়কে সংঘাতের অংশ বানানো একটি বিপজ্জনক কৌশল। এই ধরনের অভিযোগ, বিশেষ করে প্রমাণহীনভাবে, শুধু উসকানি বাড়ায় না, ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যেও আতঙ্ক ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করে।
লাহোরে বসবাসরত শিখ সম্প্রদায়ের মানবাধিকার কর্মী সর্দার তরণ সিং বলেন, 'আমরা পাকিস্তানে বহু বছর ধরে আমাদের ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর যথাযথ সম্মান ও নিরাপত্তা পেয়ে আসছি। কারতারপুর করিডর তারই একটি বড় উদাহরণ। এমন প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান স্বর্ণমন্দিরে হামলা চালাতে চেয়েছে-এই দাবিকে আমি সুস্পষ্ট মিথ্যা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে করি।
লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়া পিস ফোরামের সিনিয়র ফেলো অ্যামেলিয়া বার্ক বলেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যখন সংঘাত চরমে পৌঁছায়, তখন বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়িয়ে দেয়া অনেক সময় রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু ধর্মীয় উপাসনালয়ের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতেও গুরুতর এবং এটি সাম্প্রদায়িক হানাহানির জন্ম দিতে পারে।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আসিফ রেজা বলেন, ‘স্বর্ণমন্দিরের মতো একটি স্থাপনা নিয়ে এমন অভিযোগ করা যুদ্ধের মাঠকে ধর্মীয় স্তরে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা মাত্র। যদি পাকিস্তান আসলেই এইরকম কিছু পরিকল্পনা করত, তাহলে তা ধরা পড়ার আগে প্রতিরোধ করা যেত না—এই দাবিও যুক্তিসঙ্গত নয়। বরং এটি ভারতীয় জনমতকে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পথে পরিচালনার একটি স্ট্র্যাটেজি বলেই প্রতীয়মান হয়।’
ধর্মতত্ত্ববিদ ও আন্তঃধর্ম সংলাপ গবেষক ড. নাদিয়া রহমান বলেন, ‘পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বহু যুগ ধরে ধর্মীয় অনুভূতিকে ঘিরে রাজনীতি হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে যখন ধর্মীয় সহনশীলতা ও আন্তঃধর্ম সম্প্রীতি এত বেশি প্রয়োজন, তখন পবিত্র স্থানের বিরুদ্ধে হামলার মতো গুজব ছড়ানো খুবই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ। ভারত-পাকিস্তানের মতো পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর উচিত মিথ্যা প্রচারণার বদলে শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে যাওয়া।’ অনুবাদ: চ্যানেল২৪