জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সবকিছুই হয়ে উঠছে সহজ এবং আধুনিক। খাবার গরম করার জন্য চুলার পরিবর্তে বেড়েছে মাইক্রোওয়েভ ওভেনের ব্যবহার।
তবে অনেকের মনেই প্রশ্ন আসে এটি কতখানি নিরাপদ এবং ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করছে কি না। এই সম্পর্কে জানিয়েছেন সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. হাসান মোস্তফা রাশেদ।
মাইক্রোওয়েভ ওভেনে খাবার গরম করলে কি সত্যি ক্যানসার হতে পারে?
ডা. হাসান মোস্তফা বলেন, মাইক্রোওয়েভ এখন অনেকের রান্না ঘরের নিত্যসঙ্গী হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে যারা খুব ব্যস্ত থাকেন, তাদের জন্য এই যন্ত্র খুবই প্রয়োজনীয়। মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম করলে সাধারণত ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি নেই, যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়। মাইক্রোওয়েভ ওভেন ব্যবহার করে ক্যানসার হতে পারে এমন কোনো প্রমাণও নেই।
এ জন্য প্রথমেই বোঝা উচিত কীভাবে কাজ করে মাইক্রোওয়েভ। এতে যে রেডিয়েশন কাজ করে, সেটিকে বলা হয় নন আয়োনাইজিং রেডিয়েশন। রেডিয়েশনের মাত্রার ওপর নির্ভর করে তা ক্যানসারের আশঙ্কা বাড়াবে কি না, যেমন এক্স-রে বা সিটি স্ক্যানেও রেডিয়েশন হয়। কিন্তু তার তুলনায় মাইক্রোওয়েভে রেডিয়েশনের মাত্রা কম।
তবে নন আয়োনাইজিং রেডিয়েশন মানেই যে তা নিরাপদ তাও নয়। কারণ আল্ট্রা ভায়োলেট লাইটও এক ধরনের নন আয়োনাইজিং রেডিয়েশন এবং তা ক্যানসারের আশঙ্কা তৈরি করতে পারে।
মাইক্রোওয়েভ ওভেন ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ তৈরি করে যা খাবারের অণুগুলিকে (বিশেষ করে পানির অণু) কম্পিত করে তাপ উৎপন্ন করে। মাইক্রোওয়েভের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গগুলো নন-আয়োনাইজিং হওয়ার কারণে রাসায়নিক বন্ধন ভাঙার মত ক্ষমতা এই ওয়েভের নেই। এটি রেডিওঅ্যাকটিভিটি বা ডিএনএ-ক্ষতিকর বিকিরণ, যেমন- এক্স-রে বা গামা রে তৈরি করে না। ফলে কোষের ডিএনএর ক্ষতি যা থেকে পরবর্তী ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে না।
তবে মাইক্রোওয়েভ ওভেন ব্যবহার করার সময় ফুড সেফটি মেজার বা নিরাপদ খাদ্য পদ্ধতি মেনে চলতে হবে। যেসব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে-
১. মাইক্রোওয়েভ সেইফ পাত্র ব্যবহার করুন। পলিস্টাইরিন বা নিম্নমানের প্লাস্টিক এড়িয়ে চলুন। মাইক্রোওয়েভ নিরাপদ হিসেবে লেবেলযুক্ত নয় এমন প্লাস্টিকের পাত্র ব্যবহার করা এড়িয়ে চলুন।
২. বিসফেনল এ (বিপিএ) কখনও কখনও প্লাস্টিকের পাত্রে পাওয়া যায়। প্লাস্টিকের পাত্রে খাবার গরম করলে বিপিএ বা অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক খাবারে মিশতে পারে। এক্ষেত্রে মাইক্রোওয়েভ নিরাপদ কাঁচ বা সিরামিক পাত্র ব্যবহার করুন।
৩. খাবার ঢেকে গরম করতে হবে। কারণ খাবার ছিটানোর মাধ্যমে ওভেনের ভেতরের পরিবেশ ময়লা হয়, যেখানে জীবাণু জন্মাতে পারে বা পোকামাকড় খাবারের অন্বেষণে আসতে পারে ও ডিম পারতে বা বর্জ্য নিক্ষেপ করতে পারে, যা খাবারকে নষ্ট করতে পারে।
৪. কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, খুব বেশি তাপে (গ্রিল বা ফ্রাইয়ের ক্ষেত্রে) কিছু খাবারে কার্সিনোজেনিক যৌগ তৈরি হতে পারে, তবে এটি মাইক্রোওয়েভের স্বাভাবিক ব্যবহারে সাধারণত হয় না। ৩০০ ডিগ্রির ওপর গরম করলে তা ক্যানসার বা অন্যান্য অসুখের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিতে পারে। তবে তার সঙ্গে মাইক্রোওয়েভের রেডিয়েশনের সম্পর্ক নেই, বেশি তাপমাত্রায় রান্নার সম্পর্ক আছে।
৫. মাইক্রোওয়েভ যন্ত্র থেকে রেডিয়েশন বাইরে আসে না। মাইক্রোওয়েভের দরজা বা সিল ক্ষতিগ্রস্ত না হলে এর থেকে রেডিয়েশন লিক করার কোনও আশঙ্কা থাকে না। সুইচ বন্ধ করে দিলে এর ভিতরে আর রেডিয়েশন থাকে না। তবে মাইক্রোওয়েভ ভেঙে গেলে তা কখনও ব্যবহার করা উচিত নয়। এই বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত।
৬. কোন খাবার গরম করবেন সেই সম্পর্কে ধারণা থাকাও জরুরি। অনেকেই মাইক্রোওয়েভ ওভেনে পুরোনো ভাত গরম করে খান। ভাত গরম করলে তাতে ব্যাসিলাস সেরেসাস নামক ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয়। এই ব্যাকটেরিয়া শরীরে গিয়ে টক্সিন বা বিষ উৎপন্ন করে। এতে পেটে বিষক্রিয়া হয়ে পেট ব্যথা, বমি, পাতলা পায়খানা হতে পারে। তাই ভাত গরম করার ক্ষেত্রে ওভেন বেছে না নিয়ে চুলায় গরম করাই শ্রেয়। মাইক্রোওভেনে গরম করা খাবারে ভিটামিন বি-১২ অকার্যকর করে পড়ে। খাবার গরম করার সময় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ভিটামিন বি-১২ নষ্ট হয়ে যায়। দুধ ও মাংসজাতীয় খাবারে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি-১২ থাকে। এসব খাবার মাইক্রোওভেনে গরম করার পর খাদ্যগুণ বহুলাংশে নষ্ট হয়ে যায়।
ডব্লিউএইচও এবং এফডিএর মত
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) মতে, সঠিকভাবে ব্যবহার করলে মাইক্রোওয়েভ সম্পূর্ণ নিরাপদ। এই নিয়মগুলো মেনে চললে মাইক্রোওয়েভে রান্না করা পুরোপুরি নিরাপদ এবং এতে খাবারের পুষ্টিগুণও বেশিরভাগ মাত্রায় বজায় থাকে। উৎস: ডেইলিস্টার।