এফএনএসের প্রতিবেদন।। দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ চিকিৎসা ব্যয় মেটাতেই প্রতি বছর দারিদ্র্যসীমার নিচে নামছে। বছরে এর পরিমাণ প্রায় ৬১ লাখ। স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির নামে সরকারি বরাদ্দ ও দাতা সংস্থার আর্থিক সহায়তায় বড় বড় প্রকল্প নেয়া হলেও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় আসেনি পরিবর্তন। দেশের সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা, সংকট, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা তীব্র।
ঢাকার বাইরে পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে দেশের জেলা শহরগুলো থেকে হৃদরোগ, স্ট্রোকের জরুরি রোগী নিয়ে ঢাকায় ছুটতে হয়। আর বেসরকারি হাসপাতাগুলোতে রয়েছে আস্থার সংকট, প্রতারণার ফাঁদ। টেস্টের দাম নির্ধারণ না হওয়ায় রোগীর কাছ থেকে গলাকাটা দাম রাখা হয়। তাছাড়া হাসপাতালের ক্যাটাগরি নির্ধারণ করে মূল্য তালিকা নির্দিষ্ট না করায় অপারেশনের খরচ, শয্যা ভাড়া আদায় করছে যার যার ইচ্ছামতো। জীবন বাঁচাতে রোগী ও তার পরিমাণ দারিদ্যসীমার নিচে নেমে গেলেও অবৈধভাবে টাকা হাতিয়ে নেয়া স্বাস্থ্য প্রতারক চক্র দেশজুড়েই সক্রিয়। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সরকারি সংস্থা বিআইডিএসের ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্যানুযায়ী দেশের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ এই স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। অর্থাৎ তখন দেশে যত দরিদ্র মানুষ ছিলো, তার মধ্যে স্বাস্থ্যগত কারণে ২০ শতাংশ দরিদ্র হয়েছে। মূল কারণ মানুষের পকেট ব্যয় চিকিৎসা বাবদ বেড়ে যাওয়া। বর্তমানে দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, জেলা বা জেনারেল হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ মোট ৭৫০টি বিভিন্ন হাসপাতাল রয়েছে। তার বাইরেও সরকারের বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। নিবন্ধনকৃত বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট শয্যাসংখ্যা ১ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি। তার মধ্যে বেসরকারিতেই রয়েছে প্রায় ৯৫ হাজার শয্যা। বেসরকারি রোগ নিরীক্ষা কেন্দ্র রয়েছে প্রায় ১০ হাজার ও ব্লাডব্যাংক ১৮০টি।
সূত্র জানায়, চিকিৎসা খাতে রোগীর ওষুধের পেছনে সবচেয়ে বেশি খরচ হয়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণার তথ্যানুযায়ী ক্যানসার, হৃদরোগ, লিভার ও কিডনির চিকিৎসায় রোগী ও রোগীর পরিবার সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া রোগীদের মাসিক প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টাকা ব্যয় হয়। আর মাসে গড়ে সবচেয়ে বেশি ১৯ হাজার টাকা ক্যানসার রোগীর ব্যয় হয়। তাছাড়া হৃদরোগের পেছনে ব্যয় হয় ৮ হাজারের বেশি। মূলত ওষুধ কিনতেই রোগীর পকেট খালি হয়। মোট চিকিৎসা ব্যয়ের অর্ধেকের বেশিই ওষুধের পেছনে যায়। তারপরই রয়েছে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসকের ফি। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক গবেষণার তথ্যানুযায়ী একজন রোগীকে চিকিৎসা নিতে ৬৮ দশমিক ৫০ ভাগ টাকা নিজ পকেট থেকে ব্যয় করতে হচ্ছে। তার মধ্যে ওষুধ খাতেই রোগীকে সবচেয়ে বেশি ৬৪ ভাগ টাকা ব্যয় করতে হয়। নিজ পকেট থেকে ব্যয় বাড়ার কারণে প্রয়োজন থাকলেও চিকিৎসা নিতে পারেন না ১৬ দশমিক ৪ ভাগ রোগী। পরিস্থিতির উত্তরণে দেশের চিকিৎসা ব্যয় কমানো স্বাস্থ্যবিমা ছাড়া সম্ভব নয়। কারণ দিনে দিনে রোগের প্রকোপ, আশঙ্কাজনক হারে রোগী বাড়ার পাশাপাশি চিকিৎসা খরচ বেড়েই চলেছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ জানান, আস্থা সঙ্কটে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা। এখানে চিকিৎসা খরচ বেশি। আর চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগীদের দুর্ভোগেরও শিকার হতে হয়। চিকিৎসা সবই ঢাকা-কেন্দ্রিক। পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকারি হাসপাতালে কার্যকর সেবা নিশ্চিত করা জরুরি। আর বেসরকারি হাসপাতালে সেবার দাম ও মান নির্ধারণ করে সেটা টানিয়ে রাখতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ক্যাটাগরি অনুযায়ী দাম ঠিক করা প্রয়োজন। তাতে রোগী তার সামর্থ্য অনুযায়ী সেবা নিতে পারবে। পাশাপাশি ডায়াগনস্টিকেও দাম নির্ধারণ করে মান নিশ্চিত করা এবং চালু করতে হবে প্রেসক্রিপশন অডিট। একই সঙ্গে জোরদার করতে হবে সরকারি হাসপাতালে ডায়াগনস্টিক সেবা।