শিরোনাম
◈ সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের মরদেহ মিলল মেঘনা নদীতে: পুলিশ ◈ অস্ট্রেলিয়াকে লজ্জায় ডু‌বি‌য়ে সি‌রিজ জিত‌লো দ‌ক্ষিণ আ‌ফ্রিকা ◈ জাপানে বাংলাদেশ দূতাবাসে এনআইডি সেবা চালু ◈ উদ্বোধনের পরদিনই ভাসানী সেতুর ল্যাম্পপোস্টের তার চুরি, অন্ধকারে রাতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা! ◈ কাপাসিয়ায় জমে উঠেছে 'পাকা তাল' বিক্রি! ◈ কক্সবাজারে পুলিশ হেফাজতে যুবকের রহস্যজনক মৃত্যু, সমালোচনার ঝড় ◈ স্থায়ী ক্যাম্পাস দাবিতে মধ্যরাতে উত্তাল কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়, কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা ◈ বাহরাইন-বাংলা‌দেশ ফুটবল ম‌্যাচ রাত ৯টায় ◈ হঠাৎ কেন বদলে যাচ্ছে স্মার্টফোনের ডায়াল প্যাড : কারণ কী ও করণীয় ◈ শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচার করলে তাৎক্ষণিক আইনি ব্যবস্থা: সংবাদমাধ্যমকে সতর্ক করল অন্তর্বর্তী সরকার

প্রকাশিত : ২২ আগস্ট, ২০২৫, ১০:২৪ দুপুর
আপডেট : ২২ আগস্ট, ২০২৫, ০৭:০০ বিকাল

প্রতিবেদক : মহসিন কবির

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিতে নতুন সংকট 

মহসিন কবির: জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর (প্রোপোশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) পদ্ধতি চালু করার প্রস্তাব নিয়ে রাজনীতিতে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে।  

সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের ভিত্তিতে শুধু জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষে এ পদ্ধতি চালুর বিষয়ে কাজ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে প্রস্তাবটি নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রকাশ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। বিএনপি ও সমমনা ৬টি দল ও জোট এ পদ্ধতির বিরোধিতা করছে। 

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), এবি পার্টিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি চালুর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তবে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সংসদের উচ্চকক্ষ এবং নিম্নকক্ষ দুই জায়গায় পিআর পদ্ধতি চালুর দাবি জানিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, নির্বাচনের এ পদ্ধতি সংবিধান সংস্কারের সঙ্গে জড়িত। এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য না হলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আটকে যেতে পারে।

পিআর পদ্ধতিতে ভিন্ন মত থাকবে এটা রাজনৈতিক সৌন্দর্য, কিন্তু সকলে মিলে সকল সমস্যা সমাধান করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্যকালে তিনি এ মন্তব্য করেন। 

তিনি বলেন, জনগণের উত্তরণের যাত্রা সহজ নয়। সরকার ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বললেও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পক্ষের নিত্যনতুন শর্ত ও প্রস্তাবনা জনমনে প্রশ্ন সৃষ্টি করছে।

তারেক রহমান অভিযোগ করেন, সুষ্ঠু ভোট হলে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে এমন ভেবে ‘পলাতক স্বৈরাচার’ নানা ষড়যন্ত্র করছে। তিনি আরও বলেন, কিছু পক্ষও বিএনপি ঠেকানোর রাজনীতি করছে।

জামায়াতের শর্ত ও দাবি মেনেই সরকারকে নির্বাচনে যেতে হবে মন্তব্য করে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেছেন, তাহলে নির্বাচনে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেবে জামায়াত। না হলে তারা নির্বাচনে যাবে না।

হস্পতিবার (২১ আগস্ট) বিকেলে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে জামায়াতের প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎ শেষে এসব কথা বলেন হামিদুর রহমান আযাদ।

তিনি বলেন, ‘রোডম্যাপ নির্বাচন কমিশনের দৈনন্দিন কাজ। এটি নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই জামায়াতের। তবে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হলে পিআর পদ্ধতির বিকল্প নেই।’

আযাদ আরও বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই অতীতে রাজনৈতিক ক্রাইসিস তৈরি হয়েছে। জনগণ চাইলে পিআর পদ্ধতিতে সরকারকে যেতেই হবে। সময় উত্তর দেবে। আর জনমত গঠনেই হবে জামায়াতের উত্তর।’

পিআর পদ্ধতি চালুর আগে জনগণের মতামত নিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। বুধবার (২০ আগস্ট) নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত যৌথসভা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফকালে তিনি বলেন, “পিআর পদ্ধতিতে ধারণার ভিত্তিতে কোনো নির্বাচন হতে পারে না। জনগণের কাছে জিজ্ঞেস না করেই তাদের ওপর এটা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে।”

তিনি আরও বলেন, সব দল পিআর পদ্ধতি মেনে নিলেও সংবিধান সংশোধন ছাড়া এ ধরনের নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচিত সংসদই কেবল এটি বাস্তবায়ন করতে পারে।

দেশে প্রথম ভোট সর্বোচ্চ (ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট) পদ্ধতি চালু রয়েছে। একটি আসনে যে দলের প্রার্থী অন্যদের চেয়ে বেশি ভোট পান সেই দলের প্রার্থী জয়ী হন। একই ভাবে যেই দলের প্রার্থী বেশি আসন পান, সেই দল সরকার গঠন করে। বিগত নির্বাচনগুলোতে এভাবেই ফলাফল নির্ধারিত হয়েছে। বর্তমানে রাজনীতিতে আলোচিত পিআর বা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন পাবে।

অর্থাৎ কোনো দল নির্বাচনে ১০ শতাংশ ভোট পেলে ওই দল জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ৩০টি আসন পাবে। নির্বাচনে এই পদ্ধতি চালুর পক্ষে জোরালো প্রচারণা চালাচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী আন্দোলন। যদিও বিএনপি এর ঘোর বিরোধিতা করছে। দলটি মনে করছে, এ পদ্ধতি চালুর নামে নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনকি এ পন্থায় আসন বাড়ার পথ তৈরি করতে চায় ছোট দলগুলো।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ২৯ জুন অনুষ্ঠিত বৈঠকে সংসদের নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ এবং পিআর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের প্রস্তাবে সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব একীভূত করে রাজনৈতিক দলগুলোর সমানে উপস্থাপন করে। সেখানে জাতীয় সংসদ নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ-এই দুই ভাগে বিভক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

নিম্নকক্ষে বিদ্যমান নিয়মানুযায়ী জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সংসদ-সদস্য নির্বাচনের বিধান বহাল রাখা হয়েছে। তবে সংরক্ষিত নারী আসন সংখ্যা ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করা এবং শুধু নারী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে সরাসরি নির্বাচিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আর উচ্চকক্ষে ১০০ জন প্রার্থী মনোনীত হবেন রাজনৈতিক দলগুলোর সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব হারে। উচ্চকক্ষের সদস্যরা অর্থ বিল বাদে সব ধরনের আইন প্রণয়নে পর্যালোচনা ও পরামর্শ দিতে পারবেন। সংবিধান সংশোধন, জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত চুক্তি এবং যুদ্ধ ঘোষণাসংক্রান্ত বিল নিম্নকক্ষের সঙ্গে উচ্চকক্ষের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা থাকবে। ওই দিন বৈঠকে সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার প্রস্তাবে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল উচ্চকক্ষের নির্বাচন প্রক্রিয়া ও ক্ষমতা নিয়ে মতভিন্নতা দেখা দেয়।

ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন অবান্তর ধারণা বলে মত দেন বিএনপির নেতারা। তারা নিম্নকক্ষের আসন সংখ্যার অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন নির্ধারণের দাবি জানান। ওই মত সমর্থন করে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও লেবার পার্টি। পিআর পদ্ধতির বিরোধিতা করে ১ জুলাই বিএনপি আয়োজিত ‘গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪ : জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনি ব্যবস্থা ঐক্যের পরিবর্তে বিভক্তিমূলক সমাজ এবং অস্থিতিশীল সরকার সৃষ্টির কারণ হয়ে ওঠতে পারে কিনা তা সব রাজনৈতিক নেতাকে ভেবে দেখার অনুরোধ করব। তিনি বলেন, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনি ব্যবস্থার আড়ালে আবার দেশের রাজনীতিতে ফ্যাসিস্ট পুনর্বাসনের পথ সুগম করে দেওয়া হচ্ছে কিনা, তা সবার গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার। নিত্যনতুন ইস্যু সামনে আনলে ষড়যন্ত্রকারীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ পাবে।

বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, ক্ষমতার ভাগাভাগিসহ রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য সরকার কিংবা অন্য কারও ওপর চাপ তৈরির জন্যই ‘পিআর পদ্ধতিতে’ নির্বাচনের দাবিটি সামনে আনা হয়ে থাকতে পারে। তবে তারা এও মনে করেন যে, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব না ঘুচলে সেটি আগামী বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে সংকটে ফেলে দেওয়ার মতো পরিস্থিতিও তৈরি করতে পারে।

এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার ফুয়াদ। জানান, সংসদের ২০০ আসনে আগের মতো ভোট এবং ১০০ আসন হতে পারে পিআর পদ্ধতি। এতে ভোটের অপচয় কমবে বলেও মত দেন তিনি। অন্যদিকে উচ্চ ও নিম্ন উভয় কক্ষেই পিআর পদ্ধতি চাইছে ইসলামি আন্দোলন। দলটির মুখপাত্র জানান, এ পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় বন্ধ হবে সংসদ সদস্যদের প্রভাব, কমবে দুর্নীতি।

ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ‘প্রতিটি আসনে ভোটাররা দুইটা ব্যালটে ভোট দেবে। একটা ব্যালটে হচ্ছে যেখানে যেখানে প্রার্থীরা নির্বাচন করছেন সেখানে ওই প্রার্থীদের তারা সিল দেবেন। আর একটা হচ্ছে তারা একটা দলকে ভোট দেবেন। ছোট বড় সকল রাজনৈতিক দল তাদের ভোটার এবং জনগণের অংশগ্রহণের একটা সংসদ হওয়া সম্ভব যদি আমরা এই সিস্টেমে যাই।’

'পি আর' পদ্ধতি কী?
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা 'পি আর' পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলগুলো প্রাপ্ত মোট ভোটের অনুপাতে সংসদে আসন পায়। যেমন, কোনো দল যদি ৩০% ভোট পায়, তাদের সংসদেও ৩০% আসন বরাদ্দ হবে।

'পি আর' পদ্ধতিরও ধরন রয়েছে৷ সেগুলো হলো— ১. ক্লোজড লিস্ট পিআর: যেখানে দল প্রার্থী তালিকা দেয়, ভোটার কেবল দলকে ভোট দেন। ২. ওপেন লিস্ট পিআর: যে পদ্ধতিতে ভোটার প্রার্থী নির্বাচনেও মত দিতে পারেন। এবং সবশেষ হলো ৩. মিক্সড পদ্ধতি: যেখানে এক অংশ FPTP, অন্য অংশ 'পি আর'।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে 'পি আর' পদ্ধতির পক্ষে যুক্তি:
১. ভোটের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা:
'পি আর' পদ্ধতিতে ভোটের মূল্যায়ন বেশি হয়। একক আধিপত্যের প্রবণতা কমে যায়।

২. ছোট দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত:
বর্তমানে আদিবাসী, নারী নেতৃত্বের দল, পরিবেশবাদী প্ল্যাটফর্ম—এরা ভোট পেলেও সংসদে যেতে পারে না। 'পি আর' পদ্ধতিতে তাদের সুযোগ বাড়বে।

৩. সহিংসতা ও নির্বাচনী অনিয়ম হ্রাস:
প্রতিটি ভোটের গুরুত্ব সমান হলে ভোট কেন্দ্র দখল বা সহিংসতার প্রবণতা কমে।

'পি আর' পদ্ধতির ঝুঁকি ও আপত্তি:
১. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নের আশঙ্কা:
ছোট ছোট দল জোটে না আসায় সরকার গঠন জটিল হয়ে পড়ে। বারবার সরকার পরিবর্তনের ঝুঁকি থাকে।

২. ব্যবসায়ী বা স্বার্থান্ধ গোষ্ঠীর দখল:
ধনী গোষ্ঠী বা কর্পোরেট শক্তি সহজে দল কিনে সংসদে ঢুকে যেতে পারে।

৩. আইনগত জটিলতা:
বাংলাদেশের সংবিধানে FPTP পদ্ধতি রয়েছে। 'পি আর' চালু করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়