মনজুর এ আজিজ : দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, রিজার্ভ সংকট ও আমদানি হ্রাসের কারণে বহুমূখি সংকটে পড়েছে দেশের শিল্প খাত। ব্যবসা-বাণিজ্যের এ স্থবিরতায় রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের জন্যই এই পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে মনে করেছেন বিশ্লেষকরা।
উদ্যোক্তারা বলছেন, আমদানি কমিয়ে ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অর্থনীতির জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে। ডলার সংকটে কাঁচামাল আনতে না পারা, চড়া মূল্য দিয়েও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি না পেয়ে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর কোনো কোনো কারখানার উৎপাদন সক্ষমতার চেয়ে অর্ধেকে নেমে আসছে। তাছাড়া সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় খেলাপিতে পরিণত হয়ে পড়ছেন ভালো ঋণগ্রহীতারাও। এমন পরিস্থিতিতে গভীর সংকটের মুখে পড়েছে দেশের বেসরকারি খাত।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমদানির তথ্য প্রকাশ করলেও মার্চ পর্যন্ত এলসি খোলার হিসাব দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ঈদের বাড়তি চাহিদার কারণে ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার হার বাড়লেও ক্যাপিটাল মেশিনারি বা মূলধনী যন্ত্র আমদানির জন্য খোলা এলসির হার কমেছে ২৬.০২ শতাংশ এবং এলসি নিষ্পত্তির হার কমেছে ২৮.৬৮ শতাংশ। মধ্যবর্তী পণ্য বা ইন্টারমিডিয়েট গুডসের এলসি কমেছে ১.৬১ শতাংশ, নিষ্পত্তি কমেছে ৭.৫১ শতাংশ এবং পেট্রোলিয়ামের এলসি কমেছে ৩.৮৩ শতাংশ।
অন্যদিকে ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ৬.৮২ শতাংশ হয়েছে, যা ছিল ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারির পরে আর কখনো এতটা কম হয়নি বেসরকারি খাতে ঋণ। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমলে বিনিয়োগ আরো কমবে, যার চূড়ান্ত প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানের ওপর। এতে সামষ্টিক অর্থনীতি আরো শ্লথ হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা।
সূত্র মতে, এক বছরের ব্যবধানে দেশে বেকার বেড়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) শ্রমশক্তি জরিপে এই তথ্য উঠে এসছে। এতে দেখা যায়, বর্তমানে দেশে ২৬ লাখ ৬০ হাজার বেকার আছেন। ২০২৩ সালের এই সময়ে গড় বেকারের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৯০ হাজার। গত সেপ্টেম্বর মাস শেষে দেশে পুরুষ বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৯০ হাজার, আর নারী বেকার ৮ লাখ ৭০ হাজার।
বিবিএস এর তথ্য বলছে, শ্রমশক্তিতে এখন ৫ কোটি ৯১ লাখ ৮০ হাজার নারী-পুরুষ আছেন। অথচ ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে এই সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ১১ লাখ ৫০ হাজার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা কমেছে ১৯ লাখ ৫০ হাজার। মোট শ্রমশক্তিতে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৫ কোটি ৬৫ লাখ ২০ হাজার লোক কর্মে নিয়োজিত, বাকিরা বেকার।
সামগ্রিক পরিস্থিতিতে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪.২২ শতাংশে নেমেছে। আগের সরকারের সাময়িক হিসাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫.৮২ শতাংশে নামবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছিল। কিন্তু ওই ধারণার চেয়েও কমেছে প্রবৃদ্ধির হার। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জিডিপির চূড়ান্ত হিসাবে এই তথ্য উঠে এসেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির এমন পতনের পেছনে দেশের ব্যাংক খাতে লুটপাট, অব্যাহত অর্থপাচার, রপ্তানি আয়ের সংশোধিত হিসাবসহ বেশ কিছু কারণকে দায়ী করা হয়।
এদিকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে রাজস্ব ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রায় তা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। সেই হিসাবে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বছরে ৩৬৫ দিনের প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ২৭০ কোটি টাকা আদায় করতে হতো। তবে প্রথম ৯ মাসে রাজস্ব আদায়ে বিরাট ঘাটতি দেখা দেওয়ায় তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ফলে রাজস্ব আদায়ের কাছাকাছি যাওয়াকেও খুবই চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি জাবেদ আখতার বলেন, ‘ব্যবসা বাড়লে রাজস্ব আদায় এমনিতেই বাড়বে। ব্যবসার জন্য কঠিন পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়েছে। কাস্টমস সেবা সহজীকরণ করে প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহ কিভাবে বাড়ানো যায়, সেদিকে নজর দেওয়া দরকার।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমার কারণ চলমান অনিশ্চয়তা। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়নি, কারখানায় জ্বালানি নিরাপত্তা নেই, তাছাড়া জ্বালানির দামও একবারে প্রায় ৩গুণ বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকঋণের সুদহার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৬ শতাংশ করায় বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে নিম্নমূখি ধারায় যাচ্ছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য।