এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির, সুন্দরবন থেকে :দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল মৎস্যভান্ডার নামে খ্যাতবিশ্ব ঐতিহ্য উপকূলে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে তাল পাতার পাখা । তোমার হাতপাখার বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে আসে’ জনপ্রিয় এই গানটি হয়তো ভুলে যাননি। কিন্তু সত্যিকার তালপাতার পাখা হারিয়ে যেতে বসেছে। তথ্য প্রযুক্তির আধুনিক এ যুগে তালপাতার হাতপাখার পরিবর্তে বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবহার বেড়েছে। সে সঙ্গে কমেছে তালপাতার পাখার চাহিদা।তালপাতার হাতপাখা বাঙালি সংস্কৃতির একটি প্রাচীন ঐতিহ্য এটি। বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতিতে এ পাখার একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল। তারপরও সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলায় তিন শতাধিক পরিবার এ শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত।
এক সময় নতুন জামাই কিংবা বাড়ির অতিথির জন্য ঘরে রকমারি পাখা রাখা হতো। বিভিন্ন ধরনের হাতপাখা থাকলেও তালপাখা ছিল প্রথম সারিতে। চারদিকে রঙিন কাপড়ে বাঁধানো পাখা দিয়ে অতিথিকে সম্মান জানানো বাঙালির আতিথিয়েতার একটি বিশেষ দিক। শুধু তাই নয়, তালপাতা সাহিত্যেরও একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান। হাতপাখার নতুন পাতায়, তালের পাখায় মধু মাখা ইত্যাদি নানা ধরণের লোক সাহিত্য এখনো শোনা যায় মানুষের মুখে মুখে। এসব এখন বিলুপ্তির পথে।
বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ সহ ৯উপজেলার হিন্দু পাড়ার ৫০০টি পরিবারের প্রধান পেশা তালগাছের কঁচিপাতা থেকে হাতপাখা তৈরি। যা স্থানীয় ছোট বড় ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে চলে যায় বাগেরহাট ও মোরেলগঞ্জ সহ ৯উপজেলা ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
গ্রামে ঘুরে দেখা যায় প্রায় প্রতিটি পরিবারেই এখন চলছে ব্যস্ততা। ভাদ্র মাসের তালপাকা গরমে হাতপাখার চাহিদায় বেড়ে যায়। তবে বছরের অধিকাংশ সময়ই তাদের বেকার থাকতে হয়। যে কারণে ইতোমধ্যেই অনেকেই পুরানো পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে।দাস পাড়ার ধাঞ্চীরানী বলেন, লেখাপড়া ও ঘরের কাজ সেরে প্রায় সারাদিনই ব্যস্ত থাকি পাখা তৈরিতে। প্রতিদিন অন্তত ৫০ থেকে ৬০টি পাখা তৈরি করা যায়। আর বিক্রির টাকায় সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ মিটিয়ে বাকি টাকা সংসারে লাগে। তাপসী নামে আরেকজন জানান, বাপ-দাদার আমল থেকে পরিবার হাতপাখা তৈরি করে থাকে। এটিই তাদের একমাত্র পেশা। আর এ পেশার উপর নির্ভর করেই চলছে তাদের জীবন।
দেব শঙ্কর জানান, তাল গাছের কঁচিপাতা সংগ্রহ করে পানিতে ভিজিয়ে শুকানোর পর পাখা তৈরির উপযোগী করে তোলা হয়। কিন্তু বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে তালগাছের সংখ্যা কমে গেছে। এতে করে পাতা সংগ্রহ কষ্টকর। এক সময় এসব পাতা এমনিতেই সংগ্রহ করা গেলেও এখন প্রতিটি পাতা ৫ টাকা দরে গাছের মালিকের কাছ থেকে কিনতে হয়। ফলে এখন পাখা তৈরির খরচ বেড়ে গেছে।
ঘরে ঘরে বিদুৎ। এছাড়াও সৌর বিদুৎ গ্রাম অঞ্চলের পৌঁছে গেছে। এতে করে হাতপাখার ব্যবহারও কমেছে। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরাও বেঁচে থাকার তাগিদে ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছে। আর যারা এখনো এ পেশাকে আকড়ে আছেন তাদের পক্ষেও বেশিদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
হাতপাখার শিল্পী নিখিল বিশ্বাস বলেন, সব ধরণের জিনিসের দাম বাড়লেও সেই তুলনায় হাতপাখার দাম বাড়েনি। তালপাতার পাখা তৈরিতে ১০ থেকে ১২ বছর বয়সী তাল গাছের ডাগুরসহ পাতার দরকার। সেই ডাগুরসহ পাতা শুকিয়ে গোলাকার আকৃতিতে কাটার পর ছেটে প্রয়োজন মাফিক বাঁশের শলাকা ও বাতা সেলাই করে আটকে পাখা তৈরি করা হয়।
এই হাতপাখা দৃষ্টি নন্দন করতে রঙ দিয়ে নানা ধরনের চিত্রাঙ্কন করা হয়। বর্তমানে তালপাতার পাখার চাহিদা কমে গেছে। আর পর্যাপ্ত তাল পাতাও পাওয়া যায় না। তাই এখন এ ব্যবসা বিলুপ্তির পথে। উন্নত প্রযুক্তির যুগে মানুষ আয়েসে থাকতে পারলে কাহাতক আর কষ্ট করবে?
গ্রামীণ জনপদের এক সময়ে অতি পরিচিত একটি নাম তালপাতার তৈরি হাতপাখা। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বৈদ্যুতিক ফ্যান, এয়ার কন্ডিশনারসহ নানা ধরনের প্লাস্টিক ও ফাইবারের তৈরি হাতপাখার একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে বারহাট্টাসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে প্রচন্ড গরমে এক সময়ের দেহমনে শান্তির পরশ বোলানো বাংলার ঐতিহ্যবাহী তালপাতার হাতপাখা।
আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যময় ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ তালপাতার তৈরি হাতপাখা। এটি সাধারণত তালের পাতা, বাঁশ, বেত, সুতা ও রং দিয়ে তৈরি করা হয়। এক সময়ে চৈত্র-বৈশাখ আর গরমের সময়ে গ্রামবাংলায়সবার হাতে হাতে থাকতো তালপাতার পাখা। গরমের দিনে সন্ধ্যার পর খোলা আকাশের নিচে তালপাতার পাখা হাতে শীতল পাটিতে বসে গ্রাম্য মহিলাদের গল্প গুজবের দৃশ্য হরহামেশাই দেখা যেতো। ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রচন্ড গরমে স্ত্রী তার স্বামীকে তাল পাতার পাখা দিয়ে বাতাস দেওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হওয়া ছিল চিরচেনা এক দৃশ্য।
বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতেও শহরে মানুষের কাছে তালপাতার তৈরি হাতপাখা না দেখা গেলেও গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে এখনও পওয়া যায় এ পাখা। গরমে শহরে বিদ্যুতের বেশি লোডশেডিং না হলেও গ্রামাঞ্চলে দিন-রাতের বেশিরভাগ সময়েই হয়। তাই গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং হলে এখনও এই হাতপাখার বাতাস যেন মানুষকে স্বর্গীয় অনুভূতি এনে দেয়। আধুনিক সভ্যতার দাপটে গ্রাম-বাংলার তালপাতার পাখা শিল্প আজ অস্তিত্বের সংকটে। ভবিষ্যতে পাখার ব্যবহার থাকবে কিনা তা বলা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
সরেজমিনে উপজেলা সদরসহ সাত ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ এলাকার হাতপাখা তৈরীর পেশাদার কারিগররা পাখা বানানো বন্ধ করে দিয়ে অন্য পেশায় বেছে নিয়েছেন।
পাখা বানানোর ব্যবসা বন্ধ করার কারণ জানতে উপজেলা সদরের গ্রামের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী পাড়ার পাখা তৈরির কারিগর অসিত ক্ষত্রিয়, নিরঞ্জন ক্ষত্রিয়, গুহিয়ালা গ্রামের নিলীমা ক্ষত্রিয়, নান্টু ক্ষত্রিয় সাথে কথা বললে তারা বলেন, আগে পাখা বানিয়ে বাজারে বিক্রি করে যা রোজগার হতো তা দিয়ে আমাদের সংসার চলতো। এখন কেউ আর আগের মতো পাখা কিনতে চায় না। এলাকায় আগের তুলনায় তাল গাছের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। তাছাড়া, বাঁশও কিনতে হয় চড়া দামে। ৩-৪ বছর আগে বেতের বাঁশ ১০০-২০০ টাকা দিয়ে কিনা গেলেও এখন সেই বাঁশ কিনতে হচ্ছে ৩০০-৪০০ টাকায়। বাড়তি খরচ আর পরিশ্রম করে প্রতিটি হাতপাখা ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি করে খুব একটা লাভ হয় না।
তারা আরও বলেন, কাঁচামাল সংকট ও মুনাফা কম হওয়ায় অনেক কারিগররা এই পেশা পাল্টে ফেলছেন। যারা এখনও এ পেশায় টিকে আছেন বর্তমানে তাদের অবস্থা ভালো নয়। কোনো রকমে টিকে থাকার জন্য প্রতিনিয়তই তারা সংগ্রাম করছে চলছেন। আবার কেউ কেউ বাংলার বিভিন্ন উৎসবে হাজার বছরের ঐতিহ্যকে সম্বল করে তৈরি করছেন তাল পাতার পাখা। সরকারী সহায়তা পেলে আমার এই পেশাকে আরো বড় করতে পারতাম। আমরা চাই প্রাচীন এই ঐতিহ্য টিকে থাকুক আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। ক্ষুদ্র এই কুটির শিল্প বাঁচাতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
উপজেলার গ্রামের ৭০ বছর বয়সী কৃষক জজ মিয়া বলেন, আগে আমাদের মত কৃষকরা কাঠফাটা রোদে ফসলের মাঠে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাড়ি ফিরে প্রচন্ড গরম থেকে আরাম পেতে তালপাতার পাখার ফুরফুরে বাতাসে দেহ-মনে স্বস্তি পেতাম। তখনকার সময়ে তালপাতার পাখার বিভিন্ন নাম ছিল যেমন- শঙ্খলতা, কাঞ্চনমালা, পালংপোষ, মনসুন্দরী ইত্যাদি। বিজ্ঞানের উন্নতিতে বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবহারে তালপাতার পাখার চাহিদা প্রায় বিলুপ্ত হয়েগেছে।
উপজেলা সদরের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক ও সংগীত শিল্পী কান্তি রঞ্জন রায় চৌধুরী বলেন, ‘৯০’ দশকে উপজেলা সদরের কিছু অংশ ছাড়া পল্লী গ্রমে বিদ্যুতের প্রসার ঘটেনি তখন সবার বাড়িতে বাড়িতে ছিল তালপাতার পাখা। তখন বাড়িতে অতিথি কিংবা বিশিষ্টজন কেউ আসলে প্রথমই হাতপাখার বাতাসের মাধ্যমেই অতিথিকে স্বাগত জানানো হতো। সেই সময় হাতপাখা ছাড়া কারও দিন চলত না। প্রচন্ড গরমে প্রাণ জুড়াতে তালপাতার পাখার জুড়ি ছিল না। এছাড়াও পড়ার সময়, খাবার সময় কিংবা ঘুমানোর সময়ে সবার হাতে হাতে থাকতো তালপাতার পাখা। অতিরিক্ত গরম থেকে কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার জন্য তালপাতার পাখার বিকল্প ছিল না তখন।
তিনি আরও বলেন, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এ পাখার একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তালপাতার হাতপাখা নিয়ে গ্রামবাংলার অতি পরিচিত প্রবাদ- ‘তালের পাখা প্রাণের সখা শীতকালে হয় না দেখা, গরমকালে হয় যে দেখা।’ এছাড়াও আমাদের মতো শিল্পী ও গান পাগল শ্রোতারা আজও ভুলে যাননি- প্রয়াত শিল্পী আকবর আলীর গাওয়া সেই বিখ্যাত রোমান্টিক গান- ‘তোমার হাতপাখার বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে আসে, আরও কিছু সময় তুমি থাকো আমার পাশে।’
বর্তমানে তাল পাতার পাখার ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, তালপাতার অপ্রতুলতা, উপকরণ সামগ্রীর (বেত, সুতা, রং, বাঁশ, মূলধন) মূল্যবৃদ্ধি ও ভালো বিপণন কেন্দ্রের অভাব, এই শিল্পের পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ। সরকারি সহযোগিতা পেলে এই শিল্প আবার নতুনভাবে প্রাণ ফিরে পেতে পারে।