মো. রমজান আলী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি: আমের রাজধানী হিসেবে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জে এবার আমের বাম্পার ফলন হলেও বাজারে দাম কম থাকায় বিপাকে পড়েছেন আমচাষিরা। উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলেও কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পাওয়ায় লোকসানের আশঙ্কায় রয়েছেন তারা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুরাতন আম বাজার, শিবগঞ্জের কানসাট, ভোলাহাট ও রহনপুরসহ চারটি প্রধান বাজারে ল্যাংড়া, খিরসাপাত, আম্রপালি, ফজলি ও ব্যানানা ম্যাংগোসহ বিভিন্ন জাতের আম বিক্রি হচ্ছে। তবে গত বছরের তুলনায় এবার প্রতি মণ আমে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত কম দাম পাচ্ছেন চাষিরা। এর বিপরীতে সার, সেচ, শ্রমিক ও কীটনাশকের খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ।
চাষিরা বলছেন — খরচ উঠছেই না
স্থানীয় চাষি সুমন আলী জানান, গত বছর ভালো দাম পেলেও এবার অতিবৃষ্টি ও ঈদের টানা ছুটির কারণে আম নষ্ট হচ্ছে এবং মোকামে ব্যাপারিরা আগের মতো আম কিনছেন না।
চাষি আহসান হাবিব বলেন, “মনে হচ্ছে এবার বিষ (কীটনাশক) ও সার কিনতেই পুরো টাকা উঠে যাবে না। এভাবে চলতে থাকলে অনেকেই আগামী বছর আমচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।”
বাজারে সরবরাহ বেশি, ক্রেতা কম
ঈদের লম্বা ছুটি এবং একসঙ্গে অনেক জাতের আম পাকতে শুরু করায় বাজারে সরবরাহ বেড়েছে। একই সময়ে পাইকার ও জুস কোম্পানিগুলোর ক্রয় কম থাকায় বাজারে আমের দর নিম্নমুখী।
চারটি প্রধান বাজারে জমজমাট বেচাকেনা
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার প্রধান চারটি আম বাজার হলো—
কানসাট বাজার (শিবগঞ্জ): দেশের সবচেয়ে বড় আম বাজার। দিনে প্রায় ৫০০–৬০০ ট্রাক আম দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হয়।
পুরাতন আম বাজার (চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর): মহানন্দা নদীর তীরে অবস্থিত, বহু পুরনো এই বাজারে সদর ও পাশ্ববর্তী উপজেলা থেকে আম আসে।
রহনপুর বাজার (গোমস্তাপুর): রেল সংলগ্ন এলাকা হওয়ায় এখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকার আসে।
ভোলাহাট বাজার: আম ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত, এখানে বিভিন্ন জেলার পাইকাররা আম কিনতে আসেন।
প্রশাসনের ভাষ্য ও আশার কথা
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. ইয়াছিন আলী বলেন, “ঈদের সময়টাতে আম সংগ্রহ ও বিক্রি কম থাকায় দাম কিছুটা পড়ে গিয়েছিল। তবে বর্তমানে সংগ্রহ পুরোদমে চলছে এবং বাজারে দাম কিছুটা বেড়েছে। জাতভেদে দামের পার্থক্য থাকলেও বাণিজ্যিক জাতের আম ভালো দাম পাচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আমের গঠন ও স্বাদ উন্নত হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০ মেট্রিক টন আম বিদেশে রপ্তানি হয়েছে।”
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ: আমকে শিল্প পণ্য হিসেবে দেখতে হবে
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিক বলেন, “আমকে যদি শিল্প পণ্য হিসেবে গ্রহণ করা যায়, তাহলে এর মূল্য অন্তত তিন গুণ বাড়ানো সম্ভব। আম প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে উঠলে কর্মসংস্থান বাড়বে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখা সম্ভব হবে।”
চলতি মৌসুমের চিত্র
বাগানের পরিমাণ: ৩৭ হাজার ৫০৪ হেক্টর
লক্ষ্যমাত্রা: প্রায় ৪ লক্ষ মেট্রিক টন উৎপাদন
রপ্তানি: এখন পর্যন্ত ৭০ মেট্রিক টন
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষে সম্ভাবনা যেমন আছে, তেমনি বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের অভাবে প্রতিবছরই চাষিরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাজারের স্বচ্ছতা, সংরক্ষণ সুবিধা ও বিদেশে রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ ছাড়া এই সংকটের সমাধান সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।