আমাদের শরীরের সবচেয়ে সংবেদনশীল অঙ্গগুলোর একটি হলো চোখ। আলো, রঙ, সৌন্দর্য—সবকিছুর সঙ্গে আমাদের সংযোগের মাধ্যম এটি। কিন্তু দৈনন্দিন অনিয়মিত জীবনযাপন, ঘুমের অভাব, দীর্ঘক্ষণ পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকা কিংবা পুষ্টিহীন খাদ্যাভ্যাস—সব মিলিয়ে চোখের স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হচ্ছে নিঃশব্দে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চোখের সুস্থতার জন্য শুধু বিশ্রামই নয়, সঠিক পুষ্টিও অত্যন্ত জরুরি। কারণ কিছু নির্দিষ্ট ভিটামিন, খনিজ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে পরিপূর্ণ খাবার চোখের দৃষ্টি শক্ত রাখতে এবং বয়সজনিত ছানি বা ম্যাকুলার ডিজেনারেশনের মতো জটিল রোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
হার্ভার্ডসহ বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন ‘এ’, ‘সি’, জিঙ্ক ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হলো চোখের স্বাস্থ্যের প্রধান উপাদান। নিচে এমন ১২টি বিজ্ঞানসম্মত সুপারফুডের কথা তুলে ধরা হলো, যেগুলো প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখলে দৃষ্টিশক্তি থাকবে সুস্থ, চোখও থাকবে উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত।
১. ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ
স্যামন, টুনা বা সার্ডিনের মতো সামুদ্রিক মাছে রয়েছে প্রচুর ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, বিশেষ করে DHA। এটি রেটিনার গঠনে অপরিহার্য এবং চোখে রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি করে দৃষ্টিশক্তি রক্ষা করে। গবেষণায় বলা হয়েছে, নিয়মিত ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ খেলে বয়সজনিত দৃষ্টিশক্তি হ্রাস ও ছানি হওয়ার ঝুঁকি কমে।
২. বাদাম ও বীজ
আলমন্ড, আখরোট, সূর্যমুখীর বীজ ও পিস্তা বাদামে রয়েছে ভিটামিন ‘ই’, লুটেইন ও জ্যাক্স্যানথিন, যা চোখের কোষকে অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
৩. শিম ও ডালজাতীয় খাবার
শিম, মসুর ডাল ও ছোলার মতো খাবারে থাকে জিঙ্ক, যা রেটিনায় মেলানিন তৈরিতে সাহায্য করে। এটি রাতে দেখার ক্ষমতা বাড়ায় এবং ছানি প্রতিরোধে সহায়তা করে।
৪. টকজাতীয় ফল
কমলা, লেবু, মাল্টা ও জাম্বুরায় রয়েছে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট চোখের কোষকে রক্ষা করে এবং নতুন টিস্যু গঠনে সহায়তা করে।
৫. সবুজ পাতাযুক্ত শাকসবজি
পালং শাক, কেল ও সরিষার শাকে রয়েছে লুটেইন, জ্যাক্স্যানথিন, ভিটামিন ‘এ’, ‘সি’ ও ‘কে’। এগুলো চোখের ম্যাকুলা অংশকে সুরক্ষা দেয়, যা দৃষ্টির স্পষ্টতা বজায় রাখে।
৬. গাজর
গাজরে থাকা বিটা-ক্যারোটিন শরীরে ভিটামিন ‘এ’-তে রূপান্তরিত হয়, যা কম আলোয় ভালো দেখতে সহায়তা করে এবং রাতকানা প্রতিরোধ করে।
৭. মিষ্টি আলু
মিষ্টি আলু গাজরের চেয়ে বেশি বিটা-ক্যারোটিন সরবরাহ করে এবং এতে রয়েছে চোখের রেটিনাকে সুরক্ষা দেওয়া ভিটামিন ‘এ’-এর দ্বিগুণ পরিমাণ।
৮. ডিম
ডিমের কুসুমে রয়েছে লুটেইন ও জ্যাক্স্যানথিন, যা ম্যাকুলার ডিজেনারেশনের অগ্রগতি কমায়। গবেষণায় দেখা গেছে, সপ্তাহে ২–৪টি ডিম খাওয়া এই রোগের ঝুঁকি ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে।
৯. কাঁচা বেল পিপার (মিষ্টি মরিচ)
লাল, হলুদ ও সবুজ রঙের বেল পিপারে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা চোখের কোষ রক্ষা করে এবং রক্তপ্রবাহ সচল রাখে।
১০. স্কোয়াশ বা শীতকালীন কুমড়া
এতে থাকা ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ রাতকানা প্রতিরোধে সহায়তা করে এবং ছানি ও ম্যাকুলার ডিজেনারেশনের ঝুঁকি কমায়।
১১. ব্রোকলি ও ব্রাসেলস স্প্রাউটস
এই সবজিগুলো ভিটামিন ‘সি’ ও ক্যারোটিনয়েডে সমৃদ্ধ। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ৫০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’ গ্রহণ ছানির ঝুঁকি প্রায় ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে।
১২. পানি
চোখের শুষ্কতা, জ্বালাপোড়া বা ঝাপসা দেখার অন্যতম কারণ পানিশূন্যতা। পর্যাপ্ত পানি পান করলে চোখ সজীব থাকে এবং রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক থাকে।
চোখের জন্য কোন পুষ্টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ?
চোখের জন্য ভিটামিন ‘এ’ হলো অপরিহার্য, কারণ এটি রেটিনার স্বাস্থ্য বজায় রাখে। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড চোখের কোষের ক্ষয় রোধ করে, আর ভিটামিন ‘সি’ ও ‘ই’ কোষকে রক্ষা করে বাহ্যিক ক্ষতি থেকে।
ফলমূল, শাকসবজি ও কম চর্বিযুক্ত খাবারে ভরপুর খাদ্যাভ্যাস চোখের রক্তনালিকে সুস্থ রাখে, ফলে চোখ পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি পায়।
খাদ্য না সাপ্লিমেন্ট—কোনটি ভালো?
চোখের পুষ্টির জন্য প্রাকৃতিক খাবারই সেরা উৎস। তবে কারও খাদ্য থেকে পর্যাপ্ত ভিটামিন বা খনিজ না পাওয়া গেলে চিকিৎসকের পরামর্শে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে ধূমপায়ীদের জন্য বিটা-ক্যারোটিনযুক্ত সাপ্লিমেন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, কারণ এটি ফুসফুস ক্যান্সারের আশঙ্কা বাড়ায়।
চোখের যত্নে অতিরিক্ত কিছু টিপস
নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম, রোদে সানগ্লাস ব্যবহার, ধূমপান ত্যাগ এবং দীর্ঘক্ষণ পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকলে মাঝে মাঝে চোখ বিশ্রাম দেওয়া—এসব অভ্যাস চোখের সুস্থতা বজায় রাখতে সহায়ক।
চোখ আমাদের জীবনের আলো। তাই আজ থেকেই খাদ্যতালিকায় যুক্ত করুন এই পুষ্টিকর ১২টি সুপারফুড এবং নিজের চোখকে দিন দীর্ঘস্থায়ী সুস্থতা ও উজ্জ্বলতা।
সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ