বসন্তের আগমনে বাজারে প্রচুর পরিমাণে দেখা মিলছে রসালো ফল জাম্বুরা। ভিটামিন সি, ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর এই ফলটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে দারুণ কার্যকরী হিসেবে পরিচিত। তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, আপাতদৃষ্টিতে উপকারী এই ফলটি সবার জন্য নিরাপদ নয়। বিশেষ কিছু শারীরিক অবস্থা এবং নির্দিষ্ট ওষুধ সেবনকারীদের ক্ষেত্রে জাম্বুরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে।
জাম্বুরার সবচেয়ে বড় ঝুঁকিটি হলো ওষুধের সাথে এর মিথস্ক্রিয়া। আমাদের শরীরে বিভিন্ন ওষুধ প্রক্রিয়াজাত করার জন্য লিভার এবং অন্ত্রে CYP3A4 নামক একটি এনজাইম কাজ করে। জাম্বুরাতে থাকা ফিউরানোকুমারিনস (furanocoumarins) নামক রাসায়নিক উপাদান এই এনজাইমের কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত করে।
ফলে, যে ওষুধগুলো এই এনজাইমের মাধ্যমে বিপাক হয়, সেগুলো শরীরে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে শোষিত হয়ে যায়। এতে ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব বা বিষক্রিয়া দেখা দিতে পারে, যা কখনো কখনো মারাত্মক হতে পারে।
যেসব ওষুধের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি:
কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ (স্ট্যাটিন): অ্যাটোরভাস্ট্যাটিন (Atorvastatin), সিমভাস্ট্যাটিন (Simvastatin) এবং লোভ্যাস্ট্যাটিন (Lovastatin) এর মতো ওষুধ জাম্বুরার সাথে গ্রহণ করলে পেশিতে তীব্র ব্যথা (Rhabdomyolysis) এবং কিডনি বিকল হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ (ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার): নিফেডিপাইন (Nifedipine), ফেলোডিপাইন (Felodipine) এর মতো ওষুধের সাথে জাম্বুরা খেলে রক্তচাপ অতিরিক্ত কমে যেতে পারে, যা মাথা ঘোরা এবং অজ্ঞান হওয়ার কারণ হতে পারে।
অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের ওষুধ: অ্যামিওডারোন (Amiodarone) এর মতো ওষুধের কার্যকারিতা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়িয়ে হৃদযন্ত্রের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্টের ওষুধ (ইমিউনোসাপ্রেসেন্টস): সাইক্লোস্পোরিন (Cyclosporine) বা ট্যাক্রোলিমাস (Tacrolimus) এর মতো ওষুধ সেবনকারীরা জাম্বুরা খেলে শরীরে ওষুধের মাত্রা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যেতে পারে।
যাদের কিডনির কার্যকারিতা কমে গেছে, তাদের রক্তে পটাশিয়াম পরিশোধনের ক্ষমতা হ্রাস পায়। জাম্বুরা পটাশিয়ামের একটি ভালো উৎস। তাই কিডনি রোগীরা, বিশেষ করে যাদের রক্তে ইতোমধ্যে পটাশিয়ামের মাত্রা বেশি (হাইপারক্যালেমিয়া), তারা জাম্বুরা খেলে রক্তে পটাশিয়ামের মাত্রা আরও বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হওয়া, এমনকি হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে।
একই কারণে, যাদের আগে থেকেই অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের (Arrhythmia) সমস্যা রয়েছে, তাদের জাম্বুরা এড়িয়ে চলা উচিত।
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, মেনোপজ-পরবর্তী নারীরা যদি প্রচুর পরিমাণে জাম্বুরা বা এর রস গ্রহণ করেন, তবে তাদের শরীরে ইস্ট্রোজেনের মাত্রা প্রভাবিত হতে পারে। যদিও এই বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন, তবে বিশেষজ্ঞরা এই বয়সী নারীদের পরিমিত পরিমাণে জাম্বুরা খাওয়ার পরামর্শ দেন।
উপরোক্তกลุ่มগুলো ছাড়া সাধারণ সুস্থ ব্যক্তিরা জাম্বুরা নিশ্চিন্তে খেতে পারেন। এটি তাদের জন্য অত্যন্ত উপকারী একটি ফল।
ডায়াবেটিস রোগী: জাম্বুরার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম এবং এতে থাকা ফাইবার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তাই ডায়াবেটিস রোগীরা পরিমিত পরিমাণে এটি খেতে পারেন।
ওজন কমাতে ইচ্ছুক ব্যক্তি: এতে ক্যালরির পরিমাণ কম এবং ফাইবারের পরিমাণ বেশি থাকায় এটি খেলে দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা থাকে। এর মধ্যে থাকা কিছু এনজাইম চর্বি কমাতেও সাহায্য করে বলে মনে করা হয়।
সাধারণ সুস্থ ব্যক্তি: ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের দুর্দান্ত উৎস হওয়ায় এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ত্বককে সুস্থ রাখে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, "যেকোনো খাবার, তা যত উপকারীই হোক না কেন, সবার জন্য সমানভাবে কাজ করে না। যারা কোনো দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছেন বা নিয়মিত কোনো ওষুধ সেবন করছেন, তাদের নতুন কোনো খাবার খাদ্যতালিকায় যোগ করার আগে অবশ্যই চিকিৎসক বা পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া উচিত। জাম্বুরার ক্ষেত্রে এই সতর্কতা অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরি।"
উপসংহার: জাম্বুরা নিঃসন্দেহে একটি পুষ্টিকর ফল, তবে এটি সবার জন্য নয়। আপনি যদি কোনো ওষুধ গ্রহণ করেন বা আপনার যদি কিডনি, হৃদযন্ত্রের সমস্যা থাকে, তবে জাম্বুরা খাওয়ার আগে আপনার চিকিৎসকের সাথে কথা বলে ঝুঁকি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিন।
সূত্র:
U.S. Food and Drug Administration (FDA) - Grapefruit Juice and Some Drugs Don't Mix.
Mayo Clinic - Grapefruit: Beware of dangerous medication interactions.
NHS (UK) - Does grapefruit affect my medicine?
American Heart Association Journals.
National Kidney Foundation.