দৈনন্দিন জীবনের অন্যতম সাধারণ একটি অভ্যাস হলো রাতের খাবার খেয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়া। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই আপাত নিরীহ অভ্যাসটিই হতে পারে গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD), হার্টবার্ন, এমনকি ওজন বৃদ্ধিসহ একাধিক মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ।
কেন এই অভ্যাসটি এত বিপজ্জনক?
বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. শাহনাজ চৌধুরি বলেন, “আমরা যখন খাবার খাই, তখন তা পাকস্থলীতে গিয়ে হজম হতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়া সঠিকভাবে চলার জন্য মাধ্যাকর্ষণ শক্তির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। খাবার খেয়ে সোজা হয়ে বসে থাকলে বা কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলে খাবার ও পাচক রস (Stomach Acid) সহজেই নিচের দিকে পরিপাকতন্ত্রের পরবর্তী অংশে চলে যায়।”
কিন্তু খাওয়ার পরপরই শুয়ে পড়লে মাধ্যাকর্ষণের সেই সুবিধা আর পাওয়া যায় না। এর ফলে পাকস্থলীর অ্যাসিডযুক্ত খাবার ওপরের দিকে উঠে এসে খাদ্যনালীতে (Esophagus) ফিরে আসতে পারে। এই অবস্থাকেই অ্যাসিড রিফ্লাক্স বলা হয়।
সূত্র: Johns Hopkins Medicine এবং Mayo Clinic-এর স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা অনুযায়ী, এই অ্যাসিড রিফ্লাক্সের কারণেই মূলত বুক জ্বালাপোড়া (Heartburn), গলা ও মুখে টক স্বাদ অনুভূত হওয়া এবং পেটে অস্বস্তির মতো সমস্যাগুলো দেখা দেয়।
শুধু হজমের সমস্যাই নয়, রয়েছে আরও বিপদ
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আরও কয়েকটি গুরুতর ঝুঁকির কথা উল্লেখ করেছেন:
১. গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (GERD): নিয়মিত অ্যাসিড রিফ্লাক্স হতে থাকলে খাদ্যনালীর ভেতরের প্রাচীর ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ GERD-তে রূপ নিতে পারে। এর ফলে খাবার গিলতে অসুবিধা, বমি বমি ভাব এবং দীর্ঘমেয়াদী কাশির মতো সমস্যাও হতে পারে।
২. ** ঘুমের ব্যাঘাত:** রাতে অ্যাসিড রিফ্লাক্সের কারণে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতে পারে। বুকে ব্যথার কারণে ঘুমে অস্বস্তি হয়, যা সার্বিকভাবে ঘুমের গুণমান নষ্ট করে দেয়।
৩. ওজন বৃদ্ধি: একাধিক গবেষণা বলছে, খাওয়ার পর শুয়ে পড়লে শরীরের ক্যালোরি পোড়ানোর হার কমে যায়। এতে শরীরে চর্বি জমার প্রবণতা বাড়ে, যা ওজন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
৪. খাদ্যনালীর ক্ষতি: দীর্ঘ সময় ধরে খাদ্যনালী যদি পাকস্থলীর শক্তিশালী অ্যাসিডের সংস্পর্শে আসে, তাহলে এর ভেতরের মিউকাস স্তরের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে, যা থেকে ভবিষ্যতে জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও করণীয়
এই ঝুঁকি এড়াতে বিশেষজ্ঞরা কিছু সহজ নিয়ম মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন:
সময় দিন: রাতের খাবার এবং ঘুমানোর মধ্যে অন্তত ২ থেকে ৩ ঘণ্টা বিরতি দিন। এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম। এই সময়ের মধ্যে খাবার পাকস্থলী থেকে ক্ষুদ্রান্ত্রে চলে যায়, ফলে রিফ্লাক্সের ঝুঁকি প্রায় থাকে না বললেই চলে।
হালকা হাঁটুন: খাওয়ার পরপরই শুয়ে না পড়ে ৫ থেকে ১০ মিনিট ঘরের ভেতর বা বারান্দায় ধীরেসুস্থে হাঁটাহাঁটি করুন। এতে হজম প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয় এবং শরীর স্বস্তি বোধ করে।
হালকা গরম পানি: ডা. শাহনাজ চৌধুরির মতে, খাওয়ার কিছুক্ষণ পর এক কাপ হালকা গরম পানি পান করলে তা হজমে সহায়তা করতে পারে।
বিছানার মাথা উঁচু রাখুন: যাদের রিফ্লাক্সের সমস্যা আছে, তারা ঘুমানোর সময় বিছানার মাথার দিকটি ৪ থেকে ৬ ইঞ্চি উঁচু করে নিতে পারেন। এতে মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে অ্যাসিড ওপরের দিকে উঠতে বাধা পায়।
খাবারে মনোযোগ: রাতে অতিরিক্ত তেল, মসলাযুক্ত বা ভারী খাবার এড়িয়ে চলুন। এই ধরনের খাবার হজম হতে বেশি সময় নেয় এবং অ্যাসিড তৈরি করে।
শেষ কথা
দৈনন্দিন জীবনের একটি ছোট পরিবর্তন আপনার স্বাস্থ্যকে বড় ধরনের ঝুঁকির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। তাই খাওয়ার পর হজম প্রক্রিয়াকে তার প্রয়োজনীয় সময় দিন এবং একটি সুস্থ জীবনযাপন করুন।
সূত্র: জনস হপকিন্স মেডিসিন, মায়ো ক্লিনিক, আমেরিকান জার্নাল অফ গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিষয়ক জার্নালে প্রকাশিত তথ্য অবলম্বনে।
