বাঙালি রান্নাঘরে মুসুর ডালের উপস্থিতি অনিবার্য। সহজপাচ্য, সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর এই ডাল আমিষ ও নিরামিষাশী উভয়ের কাছেই সমান জনপ্রিয়। প্রোটিনের একটি চমৎকার উৎস হওয়ায় এটি "গরিবের মাংস" হিসেবেও পরিচিত। তবে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী এই ডালটি সবার জন্য উপযুক্ত নয়। কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক অবস্থায় মুসুর ডাল গ্রহণ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে।
আমেরিকার কৃষি বিভাগের (USDA) ফুড ডেটা সেন্ট্রাল অনুসারে, এক কাপ (প্রায় ১৯৮ গ্রাম) রান্না করা মুসুর ডale নিম্নলিখিত পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়:
ক্যালোরি: প্রায় ২৩০ ক্যালোরি
প্রোটিন: প্রায় ১৮ গ্রাম
ফাইবার (খাদ্যআঁশ): প্রায় ১৬ গ্রাম
কার্বোহাইড্রেট: প্রায় ৪০ গ্রাম
ফোলেট (ভিটামিন বি৯): দৈনন্দিন চাহিদার প্রায় ৯০%
ম্যাঙ্গানিজ: দৈনন্দিন চাহিদার প্রায় ৪৯%
আয়রন: দৈনন্দিন চাহিদার প্রায় ৩৭%
ফসফরাস: দৈনন্দিন চাহিদার প্রায় ৩৫%
পটাশিয়াম: দৈনন্দিন চাহিদার প্রায় ২১%
এছাড়াও রয়েছে জিঙ্ক, ম্যাগনেশিয়াম এবং ভিটামিন বি১ (থায়ামিন) ও বি৬।
সূত্র: USDA FoodData Central, Healthline
মুসুর ডালের অসংখ্য উপকারিতা থাকলেও নিম্নলিখিত শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য এটি ক্ষতিকর হতে পারে:
১. উচ্চ ইউরিক অ্যাসিড ও গেঁটেবাত (Gout) রোগী:
কারণ: মুসুর ডালে মাঝারি পরিমাণে পিউরিন (Purine) নামক একটি রাসায়নিক যৌগ থাকে। শরীর এই পিউরিনকে ভেঙে ইউরিক অ্যাসিড তৈরি করে। যাদের শরীরে আগে থেকেই ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি বা যারা গেঁটেবাতের সমস্যায় ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে মুসুর ডাল ব্যথা ও প্রদাহ বাড়িয়ে তুলতে পারে।
বিশেষজ্ঞ মত: আর্থ্রাইটিস ফাউন্ডেশন (Arthritis Foundation) গেঁটেবাতের রোগীদের পিউরিন সমৃদ্ধ খাবার সীমিত পরিমাণে খাওয়ার পরামর্শ দেয়।
সূত্র: Arthritis Foundation, Mayo Clinic
২. কিডনি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি:
কারণ: কিডনি রোগীদের জন্য মুসুর ডাল দুটি কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে:
অক্সালেট (Oxalate): মুসুর ডালে অক্সালেট থাকে, যা কিডনিতে ক্যালসিয়াম অক্সালেট পাথর তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়। যাদের কিডনিতে পাথর হওয়ার প্রবণতা আছে, তাদের জন্য এটি ক্ষতিকর।
পটাশিয়াম ও ফসফরাস: মুসুর ডালে উচ্চ মাত্রায় পটাশিয়াম ও ফসফরাস থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত কিডনি শরীর থেকে এই খনিজগুলো ঠিকমতো ছেঁকে বের করতে পারে না। ফলে রক্তে এগুলোর মাত্রা বেড়ে গিয়ে হৃৎপিণ্ড ও হাড়ের সমস্যা তৈরি করতে পারে।
বিশেষজ্ঞ মত: ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশন (National Kidney Foundation) ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (CKD) রোগীদের খাদ্যতালিকায় পটাশিয়াম ও ফসফরাসযুক্ত খাবার সীমিত করার পরামর্শ দেয়।
সূত্র: National Kidney Foundation (kidney.org)
৩. হজমের সমস্যা ও আইবিএস (IBS) রোগী:
কারণ: মুসুর ডালে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার ও ফোডম্যাপ (FODMAPs) থাকে। ফোডম্যাপ হলো এক ধরনের কার্বোহাইড্রেট যা ক্ষুদ্রান্ত্রে সহজে শোষিত হয় না এবং গ্যাস, পেট ফাঁপা, পেট ব্যথা ও ডায়রিয়ার কারণ হতে পারে। যারা ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (IBS) বা বদহজমের সমস্যায় ভোগেন, তাদের জন্য মুসুর ডাল অস্বস্তিকর হতে পারে।
বিশেষজ্ঞ মত: মোনাশ ইউনিভার্সিটি (Monash University), যারা ফোডম্যাপ ডায়েটের পথিকৃৎ, তারা ডালকে উচ্চ ফোডম্যাপযুক্ত খাবারের তালিকায় রেখেছে।
সূত্র: Monash University FODMAP Diet Guide, Healthline
৪. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান যারা:
কারণ: মুসুর ডাল পুষ্টিকর হলেও এটি ক্যালোরি-ঘন (Calorie-dense) একটি খাবার। এক কাপ ডালেই প্রায় ২৩০ ক্যালোরি থাকে। ভাতের সাথে ঘি বা তেল দিয়ে রান্না করা ডাল খেলে ক্যালোরির পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। তাই যারা ওজন কমাতে বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান, তাদের পরিমাণ মতো খাওয়া উচিত। অতিরিক্ত খেলে ওজন বাড়ার ঝুঁকি থাকে।
৫. অ্যালার্জি প্রবণ ব্যক্তি:
কারণ: লেগিউম (Legume) বা ডাল জাতীয় খাবারে অনেকের অ্যালার্জি থাকে। মুসুর ডাল খাওয়ার পর কারো কারো শরীরে চুলকানি, র্যাশ, ফোলাভাব বা শ্বাসকষ্টের মতো অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। যদিও এটি খুব সাধারণ নয়, তবে ঝুঁকি থেকেই যায়।
সূত্র: American Academy of Allergy, Asthma & Immunology (AAAAI)
পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকদের মতে, মুসুর ডাল নিঃসন্দেহে একটি স্বাস্থ্যকর খাবার। সাধারণ সুস্থ মানুষের জন্য এটি অত্যন্ত উপকারী। তবে আপনার যদি উপরে উল্লিখিত কোনো শারীরিক সমস্যা, যেমন—কিডনি রোগ, গেঁটেবাত বা মারাত্মক হজমের সমস্যা থাকে, তবে খাদ্যতালিকায় মুসুর ডাল যোগ করার আগে অবশ্যই একজন চিকিৎসক বা রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নিন। সঠিক তথ্য ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে ভুল খাদ্য নির্বাচনের বিপদ থেকে নিরাপদ থাকা সম্ভব।
