বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।। 'নির্বাচনে হতে হবে ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর) পদ্ধতিতে'- জামায়াত ইসলামী নেতাদের এমন বক্তব্য নতুন করে আলোচনা তৈরি করেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। প্রশ্ন উঠছে যে, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন পদ্ধতিকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্কই আগামী নির্বাচনকে সংকটে ফেলে দেয় কি না।
কারণ দেশের এ মুহূর্তের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি দৃশ্যতই এই পিআর পদ্ধতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী শনিবারের সমাবেশ থেকে এই পদ্ধতিতেই ভোটের পক্ষে তার অবস্থান আরও সুদৃঢ়ভাবে প্রকাশ করেছে।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর হচ্ছে নির্বাচনি ব্যবস্থার এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে আসন বণ্টন হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে।
বিএনপি সংসদ নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে জামায়াতের এই তৎপরতাকে দেখছে 'নির্বাচন বিলম্বিত করার কৌশল' হিসেবে। দলটির নেতারা মনে করেন, সরকারের ঘনিষ্ঠ একটি অংশ নিজেদের স্বার্থে 'নতুন ইস্যু' সামনে এনে নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা করতে পারে।
অন্যদিকে জামায়াত বলছে, প্রচলিত পদ্ধতিতে জনমতের প্রতিফলন ঘটছে না বলেই তারা পিআর পদ্ধতি চাইছেন। দলটির একজন শীর্ষ নেতা বিবিসিকে বলেছেন, 'কোয়ালিটি নির্বাচনের' জন্যই নতুন পদ্ধতিতে নির্বাচন হওয়া উচিত বলে তারা মনে করেন।
এমন পরিস্থিতিতে দু পক্ষই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নিজেদের পক্ষে টানা এবং নিজেদের অবস্থানের পক্ষে জনমত তৈরির চেষ্টা করছে।
বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, ক্ষমতার ভাগাভাগিসহ রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য সরকার কিংবা অন্য কারও ওপর চাপ তৈরির জন্যই 'পিআর পদ্ধতিতে' নির্বাচনের দাবিটি সামনে আনা হয়ে থাকতে পারে।
তবে তারা এও মনে করেন যে, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব না ঘুচলে সেটি আগামী বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে সংকটে ফেলে দেওয়ার মতো পরিস্থিতিও তৈরি করতে পারে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে লন্ডনে বৈঠকের পর দেওয়া বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
জামায়াত পিআর নিয়ে কী বলেছে
ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় শনিবার জামায়াতে ইসলামীরা নেতারা ছাড়াও তাদের সমমনা বিভিন্ন দলের নেতারা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে ভোটের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন।
এই সমাবেশে জামায়াতের সিনিয়র নেতারা কেউ কেউ 'পিআর পদ্ধতির দাবি না মানলে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে আদায়ে'র কথা বলেছেন।
দলটি তাদের যে সাত দফা দাবিতে এই সমাবেশের আয়োজন করেছিলো তার মধ্যে একটি হলো – এই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি। সমাবেশের মঞ্চেও এটি গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা ছিলো।
জামায়াতের এই সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে অন্য কয়েকটি দলের নেতারাও পিআর পদ্ধতির কথা বলেছেন।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, নির্বাচনে উচ্চকক্ষে যারা পিআর চায় না তারা ফ্যাসিবাদী হতে চায়।
ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব ইউনুস আহমাদ বলেছেন, নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতেই হতে হবে।
পিআর ইস্যুতেই নতুন সংকট?
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে এর আগে পিআর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হলেও তাতে একমত হতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপি পিআর পদ্ধতিতে ভোটের প্রস্তাবকে আমলেই নিতে রাজি নয়।
অন্যদিকে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপি ও গণ অধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল পিআর পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছে।
এ কারণেই প্রশ্ন উঠছে যে, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে এই বিরোধ নতুন কোনো পরিস্থিতির জন্ম দেয় কি-না, যা আগামী বছরের প্রথমার্ধের সম্ভাব্য নির্বাচনকে সংকটে ফেলে দিতে পারে।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ডঃ খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলছেন, তারা মনে করেন নির্বাচনকে বিলম্বিত করার 'ষড়যন্ত্র ও কৌশল' হিসেবেই এসব ইস্যু সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে।
"নির্বাচন সময়মতোই হবে। এ নিয়ে সংকট হবে না। মানুষ ভোট দিয়ে তার প্রতিনিধি নির্বাচন করবে এবং সেই প্রতিনিধিরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। সেই ভোটই মানুষ দেখতে চায়," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
বিএনপি নেতাদের অনেকে প্রকাশ্যেই বিভিন্ন সভা সমাবেশে এই পিআর পদ্ধতির প্রস্তাবের সমালোচনা করছেন। তাদের অভিযোগ 'নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য বড় জয়' ঠেকানোর জন্যই এসব প্রস্তাব সামনে আনা হচ্ছে।
যদিও এমন অভিযোগ মানতে রাজি নন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।
তিনি বলছেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে মানুষ দলকেই ভোট দেয় এবং কোয়ালিটি নির্বাচন ও সংসদের জন্য পিআর পদ্ধতিই সর্বোত্তম বলে মনে করেন তারা।
তিনি অবশ্য এ বিষয়টিকে ঘিরে নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
"আমরাও একই ধরনের কথা বলতে পারি। কিন্তু এটি আলোচনার টেবিলে রয়েছে। এটা নিয়ে অচলাবস্থা তৈরি করে নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। একটা সমাধান ঐকমত্য কমিশনের সভা থেকে আসবে," বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, পিআর পদ্ধতিকে ঘিরে যে বিতর্ক হচ্ছে তার মূল্য উদ্দেশ্য রাজনৈতিক স্বার্থ ও ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্ন।
"দলগুলো নিজের স্বার্থ অনুযায়ী অবস্থান নিয়েছে। কেউ নিজ স্বার্থে বিরোধিতা করছে। আবার কেউ নিজেদের স্বার্থে এর পক্ষে কথা বলছে। এখানে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্নই বড়ো। নির্বাচন পর্যন্ত এটা চলতে থাকবে। নির্বাচনের আগে মীমাংসা না হলে যেভাবে আছে সেভাবেই নির্বাচন হয়ে যাবে বলে মনে করি," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তার মতে, যেহেতু সরকার প্রধান নিজেই নির্বাচন ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে হওয়ার কথা বলেছেন সেটি এখন আর পেছানোর সুযোগ নেই।
"সরকার দৃঢ় থাকলে নির্বাচন নিয়ে সংকট আমি দেখি না। দলগুলো হয়তো এসব ইস্যু এনে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে কিছুটা সুবিধা নিতে চাইছে," বলছিলেন মি. আহমেদ।
আরেকজন বিশ্লেষক ও দৈনিক নয়া দিগন্তের সম্পাদক সালাউদ্দিন বাবর বলছেন, তিনি মনে করেন জামায়াত এখন পিআর নিয়ে চাপ তৈরি করলেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচন সংকটে পড়ে এমন কিছু তারা করবে না।
"আমার মনে হয় দলগুলো জানে যে মানুষ নির্বাচন চায়। সে কারণেই এখন যে যাই বলুক, আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান হবে এবং সুন্দর একটি নির্বাচনের দিকেই দেশ এগিয়ে যাবে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা বা পিআর পদ্ধতি কী?
বর্তমান বাংলাদেশের সংসদীয় নির্বাচন ব্যবস্থায় ৩০০টি আসনে আলাদা আলাদা প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে রাজনৈতিক দলগুলো।
অন্যদিকে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর হচ্ছে নির্বাচনি ব্যবস্থার এমন একটি পদ্ধতি যেখানে আসন বণ্টন হয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি কোন দল মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ১০ শতাংশ পায়, তাহলে সেই দল আনুপাতিক হারে সংসদের ১০ শতাংশ বা ৩০টি আসন পাবেন।
পিআর বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুক্ত, গোপন ও মিশ্র তিনটি আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ এবং ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট অনুষ্ঠিত হয়।