নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশে প্রায় ৪০ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে, যা বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে বড় বাধা সৃষ্টি করছে। নীতি-নির্ধারক ও ব্যবসায়ী নেতারা মনে করছেন, বাণিজ্য-বিরোধ নিষ্পত্তি ও চুক্তি প্রয়োগের এ দীর্ঘসূত্রতা স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগের বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের মতে, দ্রুত বিরোধ নিষ্পত্তি ও বিশেষায়িত কমার্শিয়াল কোর্ট গঠন ছাড়া এ সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।
মঙ্গলবার রাজধানীর মতিঝিলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) অডিটোরিয়ামে আয়োজিত ‘ব্যবসায় বিরোধ নিষ্পত্তি ও চুক্তি প্রয়োগ কার্যক্রমের অগ্রগতি’ শীর্ষক সেমিনারে এসব অভিমত তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রপ্তানি) ও ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. আবদুর রহিম খান। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন ডিসিসিআই সহ-সভাপতি মো. সালিম সোলায়মান, পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও সংশ্লিষ্ট খাতের প্রতিনিধিরা।
ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ স্বাগত বক্তব্যে বলেন, চুক্তি, বিনিয়োগ ও মেধাস্বত্ব সম্পর্কিত বিরোধ দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রতা বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ২০০১ সালে আরবিট্রেশন অ্যাক্ট প্রণয়ন হলেও তা কার্যকর হয়নি উল্লেখ করে তিনি দ্রুত একটি ‘কমার্শিয়াল কোর্ট’ স্থাপনের দাবি জানান।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, মামলা জট দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত করছে। আদালতের বাইরে বিরোধ নিষ্পত্তি হলে আদালতের চাপ যেমন কমবে, তেমনই ব্যবসায়িক পরিবেশও উন্নত হবে। তবে সাধারণ মানুষের কাছে আরবিট্রেশন এখনো জনপ্রিয় না হওয়ায় জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। সচিব জানান, কমার্শিয়াল কোর্ট স্থাপনের খসড়া আগামী এক মাসের মধ্যে চূড়ান্ত করা হবে।
ইইউ রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার বলেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের প্রেক্ষাপটে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশকে কমার্শিয়াল কোর্ট গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে। এতে বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করবে। তিনি জানান, লজিস্টিক ও শিপিং খাতে ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগে আগ্রহী। ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুর রহিম খান বলেন, বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা শুধু এফডিআই নয়, রপ্তানি সম্প্রসারণকেও ব্যাহত করছে। তাই আদালতের বাইরে আলোচনাভিত্তিক ‘আইনি সংস্থা’ গঠনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তার। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের ডুইং বিজনেস সূচকের কন্ট্রাক্ট এনফোর্সমেন্ট সূচকে বাংলাদেশ ১৯০ দেশের মধ্যে ১৮৯তম স্থানে আছে। অর্থ ঋণ আদালতে বর্তমানে প্রায় ২৫ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে, যা ব্যবসায়িক পরিবেশের দুর্বলতাকে প্রমাণ করে। তিনি আরবিট্রেশন আইন সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দেন।
প্যানেল আলোচনায় বিডার মহাপরিচালক মো. আরিফুল হক বলেন, শুধু আইন নয়, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারও জরুরি। বিয়াকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কে এ এম মাজেদুর রহমান বলেন, ব্যবসায়িক বিরোধ নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রিতা এখন বড় উদ্বেগের কারণ। সিঙ্গাপুরভিত্তিক রাজাহ অ্যান্ড থান প্রতিষ্ঠানের কো-হেড ভিকনা রাজা বলেন, বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াতে অবকাঠামো, দক্ষ মানবসম্পদ ও শক্তিশালী কমার্শিয়াল কোর্ট অপরিহার্য।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার বিচারপতি তারেক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, কমার্শিয়াল কোর্টে অভিজ্ঞ বিচারকদের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের ঘাটতি দূর করা না গেলে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাবে না।