বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে চলমান বাণিজ্যিক টানাপোড়েন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি অব্যাহত রাখার প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্ক দ্বিগুণ করে ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। এতে করে ভারতের রপ্তানি প্রতিযোগিতায় বড় ধাক্কা লাগলেও বাংলাদেশ পেলো এক কৌশলগত বাণিজ্যিক সম্ভাবনা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত নতুন ‘রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ (পারস্পরিক শুল্ক) নীতির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র এখন অন্য দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর সেই পরিমাণেই শুল্ক আরোপ করছে, যতটা শুল্ক ঐ দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর আরোপ করে। এই নীতির লক্ষ্য হলো দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ভারসাম্য স্থাপন করা।
এই নীতির আওতায় ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫% শুল্ক আরোপ করে মোট শুল্কহার ৫০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কহার মাত্র ২০%, যা আগে ৩৫% থাকলেও আলোচনা ও কূটনৈতিক চেষ্টায় কমিয়ে আনা হয়েছে।
দেশ | যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কহার |
---|---|
ভারত | ৫০% |
বাংলাদেশ | ২০% |
পাকিস্তান | ১৯% |
ভিয়েতনাম | ২০% |
মালয়েশিয়া | ১৯% |
ইন্দোনেশিয়া | ১৯% |
ফিলিপাইন | ১৯% |
এই তুলনা থেকেই স্পষ্ট যে, ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে একটি প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পাচ্ছে।
ভারতের ওপর দ্বিগুণ শুল্ক আরোপের ফলে দেশটির রপ্তানি-নির্ভর খাতগুলো, বিশেষ করে:
তৈরি পোশাক (RMG)
চামড়াজাত পণ্য
জুতা ও অ্যাক্সেসরিজ
এই পণ্যের বাজার যুক্তরাষ্ট্রে চরম চাপে পড়বে। মার্কিন ক্রেতারা এখন এসব পণ্য কিনতে অপেক্ষাকৃত সস্তা এবং শুল্ক ছাড় সুবিধাপ্রাপ্ত দেশগুলোর দিকে ঝুঁকবে—যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় পোশাক আমদানিকারক দেশ। সেখানে ভারত ও বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিযোগী। এখন এই শুল্ক ব্যবধানের ফলে বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনা আরও বিস্তৃত হলো। বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক পরিকল্পনা ও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই কিছু বাণিজ্যিক ইস্যু রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য:
ভারত জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড (GM) ফসল ও মার্কিন দুগ্ধজাত পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে।
ভারতীয় কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ভারত এই বিষয়ে ছাড় দিতে নারাজ।
এতে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ এবং প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করেছে।
এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশকে নিচের বিষয়গুলোতে দ্রুত অগ্রগতি সাধন করতে হবে:
বিদ্যমান কারখানার উৎপাদন দক্ষতা বাড়ানো
নতুন কারখানা স্থাপন ও সম্প্রসারণে বিনিয়োগ
আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা
পরিবেশবান্ধব ও নান্দনিক ডিজাইন নিশ্চিত করা
সঠিক কোয়ালিটি কন্ট্রোল পদ্ধতি অনুসরণ
বন্দর ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন
দ্রুত রপ্তানি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য কাস্টমস ও শুল্ক কার্যক্রম সহজীকরণ
‘ফাস্ট ট্র্যাক এক্সপোর্ট’ সিস্টেম চালু করা
মার্কিন ক্রেতাদের আস্থা অর্জনের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ব্র্যান্ডিং
নতুন মার্কেট এক্সপানশন স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ
ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিগুণ শুল্ক আরোপ একটি বাণিজ্যিক বিপর্যয় হলেও বাংলাদেশের জন্য তা এক বিশাল সম্ভাবনার জানালা খুলে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নতুন করে আধিপত্য তৈরি করতে হলে এখনই সময় বাংলাদেশের সামনে। সঠিক পরিকল্পনা, কার্যকর বাস্তবায়ন এবং দৃঢ় কূটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই সুযোগকে সফলতার শিখরে পৌঁছাতে পারে।
নতুন শুল্কহার আগামী ৭ আগস্ট ২০২৫ থেকে কার্যকর হবে। এর আগেই প্রস্তুতি নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।