শিরোনাম
◈ টেকনাফে বাংলাদেশি ১২ জেলেকে ধরে নিয়ে গেল আরাকান আর্মি ◈ রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ, ১৪টি শহর বিদ্রোহীদের দখলে, নজর রাখছে চীন ও ভারত ◈ বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটেছে: সালাহ উদ্দিন আহমদ ◈ খালেদা জিয়ার সঙ্গে রোববার সন্ধ্যায় বৈঠক করবেন পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ◈ যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণা কার্নির ◈ আমাদের উপদেষ্টা যারা দায়িত্ব পালন করছেন, এখন অনেক ক্ষেত্রেই তারা অসহায়: মির্জা ফখরুল ◈ পরাজ‌য়ে শুরু, পরাজয় দি‌য়ে শেষ বাংলা‌দেশ দ‌লের টপ এন্ড টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ◈ আমাকেও বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হতে পারে: অমর্ত্য সেন ◈ ঢাকায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ‘ঐতিহাসিক’ বলছে ইসলামাবাদ ◈ ২০২৬ সালের এইচএসসি পরীক্ষার সময় জানাল এনসিটিবি

প্রকাশিত : ০২ জুন, ২০২৫, ১০:০১ দুপুর
আপডেট : ২৭ জুলাই, ২০২৫, ১০:০০ দুপুর

প্রতিবেদক : এল আর বাদল

মালয়েশিয়া শ্রমবাজার সিন্ডিকেট থেকে মুক্তি মিলবে কীভাবে?

এল আর বাদল : ছয় লক্ষ টাকা খরচে সব প্রক্রিয়া শেষে পেয়েছিলেন মালয়েশিয়ার ভিসা। ভেবেছিলেন প্রবাসে কাজ করে ঘুরবে ভাগ্যের চাকা। কিন্তু বিমানের টিকেট না পাওয়াসহ শেষ মুহুর্তের নানা জটিলতায় যাওয়া হয়নি স্বপ্নের গন্তব্যে। এখন রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজ করে ব্যাংকের ঋণ শোধ করছেন নওগাঁর সাব্বির আহমেদ।

ভিসা হওয়ার পরও মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা আরেক কর্মী দিনাজপুরের মহসিন হোসেন। বিবিসি বাংলাকে তিনি জানান, প্রবাসে পাড়ি জমাতে, ফসলি জমি বিক্রি করে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করেছিলেন। কিন্তু পূরণ হয়নি সেই আশা। বরং দেনা পরিশোধ করতে না পেরে প্রায় এক বছর আর বাড়িতে ফেরেননি তিনি।

এমনকি রিক্রুটিং এজেন্সি, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মহলে দেনদরবার করেও উদ্ধার করতে পারেননি খরচ হওয়া একটি টাকাও।

২০২৪ সালের ৩১ মে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার পর আন্দোলন-বিক্ষোভ করেও বিষয়টির কোনো সুরাহা করতে পারেননি এই কর্মীরা। সব মিলিয়ে চরম হতাশায় দিন কাটছে, বৈধ ভিসা পাওয়ার পরও মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা হাজারো কর্মীর। -- সূত্র, বি‌বি‌সি বাংলা

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের অগাস্টে চালু হওয়ার পর ওই দফায় ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৬৭২ জন মালয়েশিয়ায় যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু বিমান টিকেট না পাওয়া, রিক্রুটিং এজেন্টের গাফিলতিসহ নানা কারণে দেশটিতে যেতে ব্যর্থ হন প্রায় ১৭ হাজার কর্মী।

বাংলাদেশের জন্য চতুর্থ বৃহৎএবং অতি গুরুত্বপূর্ণ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সম্প্রতি আবারো চালু করার চেষ্টা করছে সরকার।

গত ১৪ মে মালয়েশিয়ায় দেশটির সরকারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী।
যাতে বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু হওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে আবারো। যে প্রক্রিয়া এগোবে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভার মাধ্যমে। কারণ মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে কোন কোন খাতে কত সংখ্যক কর্মী নেবে সেই সিদ্ধান্ত হবে ওই বৈঠকেই।

কিন্তু এখানেও ঘুরেফিরে আসছে সিন্ডিকেট প্রসঙ্গ। যা নিয়ে বিভক্ত জনশক্তি রপ্তানিকারকরা। কারো কারো অভিযোগ, সিন্ডিকেটের কারণে মালয়েশিয়ায় যাওয়া কর্মীদের কয়েকগুণ অর্থ খরচ করতে হচ্ছে।

এছাড়া অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি কিংবা দালালের দৌরাত্ম, এমন নানা কারণে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বারবারই সমস্যায় পড়েছে বাংলাদেশের কর্মীরা।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ঘিরে বাংলাদেশের এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা নতুন নয়।
সিন্ডিকেট তৈরির সুযোগ রেখে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু করলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না" বলেই মনে করেন অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, রামরুর চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী।

-- মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ইস্যুতে কী করছে সরকার?--

অতি গুরুত্বপূর্ণ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার আবারো চালু করতে সম্প্রতি তৎপরতা বাড়িয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

ঢাকায় ২১ ও ২২ মে অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া নিরাপদ অভিবাসন ও কর্মসংস্থান সম্পর্কিত তৃতীয় জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা। যেখানে মালয়েশিয়া সরকারের ১৪ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে বসেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। যদিও সেখান থেকে নতুন কোন ঘোষণা আসেনি।

বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলন করার কথা থাকলেও, নির্ধা‌রিত সম‌য়ের ৪৫ মি‌নিট আগে "অনিবার্য কারণ" দেখিয়ে তা বাতিল করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

অবশ্য বৈঠকের উদ্বোধনী অধিবেশনে, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম ও বৈষম্যের সুযোগ রাখা হবে না বলেও জানান মি. সিদ্দিকী।

এর আগে গত ১৪ মে মালয়েশিয়া সফর করেন বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। সেখানে দেশটির স্বরাষ্ট্র ও মানবসম্পদ বিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে যৌথ সভায় অংশ নেন তিনি।

পরে দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রী স্টিভেন সিম চি কেওয়ংয়ের বরাত দিয়ে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানান, কর্মী নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে মালয়েশিয়া। প্রথম দফায় ৭ হাজার ৯২৬ জন কর্মীকে নেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছে বলেও ভিডিও বার্তায় জানান উপদেষ্টা।

-- সিন্ডিকেট ইস্যুতে দ্বন্দ্বে জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা--

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছে।

গত ১৯ মে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে মালয়েশিয়া শ্রমবাজারের সিন্ডিকেট ইস্যুতে বায়রার এক পক্ষের ডাকা সংবাদ সম্মেলনে হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে।

বায়রার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, সিন্ডিকেটের কারণে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে কর্মীদের বাড়তি অর্থও ব্যয় হচ্ছে। কম খরচে কর্মী পাঠাতে সিন্ডিকেট প্রক্রিয়া বন্ধের বিকল্প নেই বলেই মত তার।

ফখরুল বিবিসি বাংলাকে জানান, টানা চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালে চালু হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর ১০০ এজেন্সি নিয়ে চক্র গঠন করে একটি গোষ্ঠী। কর্মীপ্রতি ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকার সর্বোচ্চ খরচ নির্ধারণ করে দিলেও গড়ে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দিতে হয়েছে কর্মীকে।

বারবার অনিয়মের অভিযোগ করার পরও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যাতে কেউ কথা বলতে না পারে সে জন্যই সংবাদ সম্মেলনে হামলা চালানো হয়েছে বলেও দাবি মি. ফখরুলের।

বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়ার ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া কেন এজেন্সি ঠিক করে দেবে এমন প্রশ্নও তোলেন মি. ফখরুল। যদিও সিন্ডিকেটের বিষয়টি সঠিক নয় বলে বিবিসি বাংলাকে জানান বায়রার সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার।

তিনি বলছেন, "দুই দেশের সরকারের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমেই জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টি নির্ধারিত হয়। বাজার স্থিতিশিল রাখতে শ্রমবাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিৎ" বলেই মনে করেন মি. বাশার।

বেশি সুবিধা পেতেই একটি পক্ষ সিন্ডিকেট ইস্যু সামনে আনছে। এর ফলে অতীতেও বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজার বাংলাদেশের জন্য বন্ধ হয়েছে" বলেও দাবি মি. বাশারের।

-- মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজারের ইতিহাস--

বাংলাদেশের শ্রমবাজারের সাথে জড়িত ব্যক্তি, জনশক্তি রপ্তানি বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আনুষ্ঠানিকভাবে দুই দেশের জনশক্তি নিয়োগের চুক্তি হয় ১৯৯২ সালে।

বাংলাদেশের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের পরেই বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহৎ শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। এ পর্যন্ত দেশটিতে প্রায় ১৫ লাখ কর্মী পাঠিয়েছে বাংলাদেশ।

বিএমইটির ওয়েবসাইটে যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৮ সালে সর্বপ্রথম ২৩ জন শ্রমিক মালয়েশিয়াতে যায়। পরের বছর কোন শ্রমিক মালয়েশিয়াতে না গেলেও ১৯৮০ সালে মাত্র তিনজন শ্রমিক যায় দেশটিতে।

এরপরের দুই বছর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে যায় নি কোনো বাংলাদেশি। দুই বছর বাদে আবার ১৯৮৩ সালে ২৩ জন মালয়েশিয়াতে যায়। এরপর ১৯৮৬ সালে সর্বোচ্চ ৫৩০ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে যায়।

এই ওয়েবসাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত অনিয়মিতভাবে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশিদের যাতায়াত চলে।

তবে, ১৯৯০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এই দেশের বাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের যাত্রা বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন সময় এ শ্রমবাজার বন্ধ হলেও এখন পর্যন্ত শুধু ২০২৩ সালেই দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ শ্রমিক গিয়েছিল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়