শাহাজাদা এমরান,কুমিল্লা: ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠেছে কুমিল্লায়। সরকারি হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর চাপ, বাড়ছে মৃত্যুও। কিন্তু এই সংকটে সবচেয়ে উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছেন নগরীর ছিন্নমূল মানুষরা। খোলা আকাশের নিচে রাত কাটানো এসব মানুষের কাছে মশারি কিংবা প্রতিরোধী ব্যবস্থা নিছক বিলাসিতা। তারা দিন পার করেন ক্ষুধার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে, আর রাত কাটে মশার কামড়ে ছটফট করে।
কুমিল্লা রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসবাসরত আনোয়ারা বেগম (৮২)। বৃদ্ধা আনোয়ারা জীবনের শেষ বয়সে এসে হয়েছেন সমাজের অবহেলার প্রতীক। পরিবার বলতে কেউ নেই। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বসবাস করছেন কুমিল্লা রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। বয়সজনিত শারীরিক নানা সমস্যায় ভুগলেও পেটের তাগিদে প্রতিদিনই করতে হয় কোনো না কোনো কাজ। রাত হলে প্ল্যাটফর্মের এক কোণে চটের বস্তা পেতে, গায়ে কাঁথা জড়িয়ে শুয়ে পড়েন। মশার কামড়ে ঘুম আসে না, কখনো যদি হাতে সামান্য কিছু টাকা থাকে, কয়েল কিনে রাখেন পাশে। কিন্তু তাতে মশার কামড় থেকে বাঁচা যায় কিনা সেটা প্রশ্নই থেকে যায়৷
শুক্রবার (১১ জুলাই) রাতে কুমিল্লা রেলস্টেশনে সরেজমিনে গেলে এমন আরও অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। কেউ সিমেন্টের বেঞ্চে আধশোয়া হয়ে আছে, কেউ চট বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে সরাসরি প্ল্যাটফর্মের ফ্লোরে। পাশে জ্বলছে কয়েল, কিন্তু তাতেও কমছে না মশার উপদ্রব। একজন বৃদ্ধ মানুষ বারবার গায়ে চুলকাচ্ছেন। পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ পরিচয় দিয়া কি হইবো ভাই৷ ঘুমাইতে পারি না ভাই, সারারাত মশা কামড়ায়। থাকার জায়গা তো এইটাই, তাই মশার কামড় খাইয়া হলেও এখানেই থাওন লাগবো।"
কেবল রেলস্টেশন নয়, কুমিল্লা নগরীর কান্দিরপাড়, রাজগঞ্জ, জাঙ্গালিয়া, শাসনগাছা, টমছমব্রিজ এলাকার অলিগলিতেও দেখা মেলে এমন ভাসমান ছিন্নমূল মানুষের। এদের অধিকাংশই কাজের সন্ধানে দিনভর ছুটে বেড়ায় আর রাত হলে খোলা জায়গায় আশ্রয় নেয়।
রেলস্টেশনের এক কোণে বসে থাকা আলমগীর হোসেন নামের এক ব্যক্তি বলেন, "আগে বাড়িঘর ছিল। ছেলে-মেয়ে বড় হওয়ার পর তারা জায়গা দিল না। বাধ্য হয়ে রেলস্টেশনে চলে আসলাম। মশার কামড় খাইতেছি, কিছু করার নাই। যেখানে ঘুমানোর জায়গা নাই, সেখানে মশার জন্য কি আর করবো। দিনে খেতেই টাকা পাই না, মশারি কেনার টাকাও নাই৷ সরকারের পক্ষ থেকে যদি আমাদের জন্য মশারি দিতো, তাহলে আমরা ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে পারতাম।"
এদিকে, সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, কুমিল্লা জেলায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। দাউদকান্দি উপজেলায় গত মঙ্গলবার আরও ৬৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন এবং নতুন করে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। উপজেলাটিতে ইতোমধ্যে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন সাতজন। জেলা পর্যায়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়াও, শুক্রবার কুমিল্লা জেলায় সরকারি হিসাব অনুযায়ী একদিনে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ২৪ জন।
এই পরিসংখ্যানের ভয়াবহতা যতটা উঠে আসে সরকারি হাসপাতালে, ততটাই অনুপস্থিত ছিন্নমূল মানুষের বাস্তবতায়। তারা আক্রান্ত হলেও অনেকেই চিকিৎসা নিতে পারেন না, আর আক্রান্ত হওয়ার আগেই কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া তাদের সাধ্যের বাইরে। এছাড়াও, লক্ষণ প্রকাশ পেলেও কেউ কেউ ডেঙ্গু টেস্ট করাতে অনাগ্রহী বলেও সরেজমিনে ঘুরে জানা যায়।
জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা যেমন জরুরি, তেমনি গুরুত্ব দিতে হবে শহরের এই অনাহারে-অবহেলায় থাকা মানুষের দিকেও। কারণ স্বাস্থ্যঝুঁকি সমাজের সব স্তরেই ছড়িয়ে পড়তে পারে।
কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন ডা. আলী নূর মোহাম্মদ বশির বলেন, ছিন্নমূল মানুষদের ডেঙ্গু আক্রান্তের ঝুঁকি রয়েছে। তারা যদি ডেঙ্গুর লক্ষণ অনুভব করে, তাহলে সদর হাসপাতাল কিংবা কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল তাদের জন্য খোলা রয়েছে৷ সেখানে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে৷
এদিকে, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন বা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ছিন্নমূল মানুষদের জন্য কোনো প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিনা, এ প্রশ্ন এখন অনেকেরই। শহরের বুকে শত শত মানুষ খোলা জায়গায় ঘুমিয়ে রাত পার করছেন, যাদের চারপাশে ছড়াচ্ছে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা। অথচ তারা যেন প্রশাসনিক নজরদারির বাইরেই রয়ে গেছেন।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে, কুমিল্লা জেলা প্রশাসক আমিরুল কায়সার বলেন, "ছিন্নমূল মানুষদেরকে শনাক্ত করা কষ্টসাধ্য কাজ। তারপরেও আমরা চেষ্টা করবো তাদেরকে শনাক্ত করে মশারির ব্যবস্থা করা যায় কিনা। এতে কিছুটা হলেও ডেঙ্গু ঝুঁকি থেকে রক্ষা মিলবে ছিন্নমূল মানুষদের। এছাড়াও, আমরা ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার প্রজননরোধে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চলমান রেখেছি। ডেঙ্গুরোধে আমরা পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।"