কিবরিয়া চৌধুরী, হবিগঞ্জ প্রতিনিধি : হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার দিনারপুর পরগণার তিনটি ইউনিয়ন—দেবপাড়া, গজনাইপুর ও পানিউমদা- বর্তমানে মাদকের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এই তিনটি পাহাড়ি ইউনিয়নের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রকাশ্যে ইয়াবা, গাঁজা ও অন্যান্য মাদকদ্রব্য বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয়দের ভাষ্য, প্রশাসনের নির্লিপ্ততা এবং রাজনৈতিক মদদপুষ্ট একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় এই মাদক কারবার দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এর ফলে তরুণ প্রজন্ম ধ্বংসের পথে, অথচ প্রতিরোধে নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ।
গজনাইপুর ইউনিয়নের কান্দিগাঁও গ্রামের কাচন মিয়া দীর্ঘদিন ধরে গালিব নূর ফিলিং স্টেশনের সামনে ইয়াবা বিক্রির সঙ্গে জড়িত। স্থানীয়রা জানান, তিনি সন্ধ্যার পর স্টেশন এলাকায় অবস্থান নিয়ে নিয়মিতভাবে ইয়াবা সরবরাহ করেন। একই গ্রামের আব্দুর রউফ মিয়া গাঁজার ব্যবসা পরিচালনা করেন দীর্ঘ সময় ধরে। তার ক্রেতা মূলত স্থানীয় যুবকরা হলেও, আশপাশের এলাকা থেকেও মাদকসেবীরা তার কাছে আসে বলে জানা গেছে।
কান্দিগাঁওয়ের আরেকটি পরিচিত নাম মৃত আমজদ মিয়ার দুই ছেলে লিটন মিয়া ও রিপন মিয়া। এই দুই ভাইয়ের বাড়ি কান্দিগাঁও রুমেল-বাকার এবতেদায়ী মাদ্রাসার বিপরীতে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, তারা সন্ধ্যার পর তাদের বাড়ির পাশের রাস্তার মুখে ইয়াবা বিক্রি করে থাকে। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মাদক মামলা রয়েছে এবং তারা কয়েকবার জেলও খেটেছে। তবে দণ্ড বা বিচার কার্যকর না হওয়ায় তারা আবারও সেই একই ব্যবসায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত আছেন কাজল মিয়া নামের আরেক ব্যক্তি, যিনি ওই দুই ভাইয়ের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। তাকেও নিয়মিত মাদক বিক্রিতে দেখা যায় বলে জানান স্থানীয়রা। গজনাইপুরের পাশের এলাকা উত্তর রামলোহ গ্রামের সবুজ মিয়া ইয়াবা বিক্রির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। রামলোহ টিলাপাড়ার আব্দুল মুকিত গাঁজা বিক্রি করেন নিজের দোকান থেকেই। তার বিরুদ্ধে এলাকার মানুষ বহুবার অভিযোগ তুললেও কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
বনগাঁওয়ের মীরটিলা এলাকায় রয়েছে গাঁজার পৃথক তিন থেকে চারটি চক্র, যারা স্থানীয়ভাবে ‘পার্টি’ নামে পরিচিত। এদের বিক্রয় কেন্দ্র মূলত সন্ধ্যার পর সক্রিয় হয়, এবং এলাকাবাসী জানালেও প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ।
দেবপাড়া ইউনিয়নের পূর্ব দেবপাড়া গ্রামের মায়েদ মিয়া এই এলাকার অন্যতম সক্রিয় ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে একাধিক মৌখিক অভিযোগ রয়েছে। এলাকাবাসীরা জানায়, মায়েদ মিয়ার মাদক ব্যবসার ফলে অনেক তরুণ নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু কেউ মুখ খুললে তাকে হুমকি-ধামকি দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়।
পানিউমদা ইউনিয়নে ইয়াবা ব্যবসার নেতৃত্বে রয়েছে গনি নামের এক ব্যক্তি, যিনি নিজেকে স্থানীয়ভাবে ‘মাদক সম্রাট’ বলে দাবি করে থাকেন। তার প্রভাব এতটাই যে, কেউ তার নাম উচ্চারণ করতেও ভয় পায়। প্রশাসনের কাছে একাধিকবার তার নাম জানানো হলেও আজ পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এই পুরো অঞ্চলে মাদকের বিস্তার এতটাই গভীর যে, সন্ধ্যা নামতেই একাধিক এলাকায় শুরু হয় যুবকদের চলাচল, যারা মাদক কেনার উদ্দেশ্যে আসে। এলাকাবাসী জানায়, প্রশাসন চাইলে এক রাতেই পুরো চক্র ধরা সম্ভব, কারণ বিক্রির সময় ও স্থান উভয়ই নির্দিষ্ট। অথচ পুলিশের উপস্থিতি দেখা যায় না, এমনকি কোনো ধরপাকড়ও হয় না।
একজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা অনেকবার প্রশাসনকে জানিয়েছি। কিন্তু যারা ব্যবসা করছে, তাদের পেছনে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক প্রভাবশালী লোক আছে। ফলে পুলিশ প্রশাসন অনেক সময় নিরুপায় হয়ে পড়ে।”
দিনারপুর পরগণার এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তরুণ সমাজ ও শিক্ষার্থী শ্রেণি। মাদকের কবলে পড়ে তারা পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছে, জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে। প্রশাসনের নির্লিপ্ততা, রাজনৈতিক মদদ এবং সমাজের মৌনতা মিলিয়ে দিনারপুর যেন এক নীরব মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে।
এই অবস্থায় এলাকাবাসীর দাবি, জরুরি ভিত্তিতে এই তিনটি ইউনিয়নে র্যাব-পুলিশের যৌথ অভিযান চালিয়ে সকল মাদক কারবারি চক্রকে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। তা না হলে নবীগঞ্জের এই পাহাড়ি অঞ্চল অচিরেই চরম সামাজিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে।