বণিক বার্তা প্রতিবেদন: ‘চালুর জন্য প্রস্তুত’ অবস্থায় আছে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নবনির্মিত থার্ড টার্মিনাল। গত মাসে টার্মিনালটি পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট। তবে টার্মিনালটি এখনই চালু হচ্ছে না। জাপানের যে কনসোর্টিয়ামকে টার্মিনাল পরিচালনার জন্য নিযুক্ত করা হবে তাদের সঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনো চুক্তি করতে পারেনি বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। সংস্থাটির একটি সূত্র বণিক বার্তাকে জানিয়েছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শেষ সময়ে টার্মিনাল পরিচালনা চুক্তি করতে আগ্রহী নয় জাপানি কনসোর্টিয়াম। এজন্য তারা চুক্তি স্বাক্ষরে ইচ্ছাকৃত বিলম্ব করছে।
বাংলাদেশ যে জাপানি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চুক্তি করতে চাইছে তার নেতৃত্বে রয়েছে দেশটির ব্যবসা ও বিনিয়োগ খাতের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি সুমিতোমো করপোরেশন। ছয় কোম্পানির এ কনসোর্টিয়ামে রয়েছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ও মিনিস্ট্রি অব ল্যান্ড, ইনফ্রাস্ট্রাকচার, ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড ট্যুরিজম। চুক্তি স্বাক্ষর হলে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করবে এ কনসোর্টিয়াম। বিনিময়ে টার্মিনাল থেকে অর্জিত রাজস্বের একটি ভাগ তারা পাবে।
২১ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল। ২০২৩ সালের অক্টোবরে টার্মিনালটি ‘সফট ওপেনিং’ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ওই সময় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) পদ্ধতিতে নতুন এ টার্মিনাল পরিচালনায় জাপানের কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়। সে সময় থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংসহ সমস্ত পরিচালনকাজ এ কনসোর্টিয়ামকে দিয়ে করানোর ব্যাপারে আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন বেবিচক কর্মকর্তারা।
তবে পরিস্থিতি পাল্টে যায় আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দুই বছরের জন্য থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কাজ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্ত জাপানি কনসোর্টিয়ামকে ক্ষুব্ধ করে বলে জানিয়েছেন বেবিচক কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে থার্ড টার্মিনালে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংসহ রাজস্ব ভাগাভাগি চুক্তিতে জাপানি কনসোর্টিয়াম সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে দেশে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে জাপানি কনসোর্টিয়াম ততদিন অপেক্ষা করবে।
যদিও জাপানি কনসোর্টিয়াম অন্তর্বর্তী সরকারকে এ ধরনের কোনো ইঙ্গিত দেয়নি বলে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। এ প্রসঙ্গে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যে কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে আমরা আলোচনা করছি তাদের কাছ থেকে এমন কোনো ইঙ্গিত পাইনি যে তারা আমাদের সঙ্গে চুক্তি করবে না।’
উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন আরো বলেন, ‘জিটুজি ভিত্তিতে জাপানের সঙ্গে আমাদের আলাপ হচ্ছে। এ আলাপের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের মধ্যে চুক্তির শর্ত নিয়ে কিছু কথাবার্তা হচ্ছে। সর্বশেষ দিন দশেক আগেও তাদের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। এ আলোচনায় আমাদের অবস্থান তাদের কাছে পরিষ্কার করেছি। এখন তাদের সর্বশেষ অবস্থান জানার জন্য অপেক্ষায় আছি। জবাব পাওয়ার পর বুঝতে পারব যে চুক্তিটা আমরা কবে করতে পারব।’
অন্যদিকে রাজস্ব ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনায় চুক্তিটি আটকে থাকার কথা বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক। তিনি বলেন, ‘এখনো দুই পক্ষ কোনো চুক্তিতে পৌঁছতে পারিনি। এখন পর্যন্ত চেষ্টা হচ্ছে। চুক্তিতে অথবা শর্তগুলোতে আমরা যখন একমত হব, তখনই আসলে চুক্তি স্বাক্ষরের সময়টা বলা যাবে। তার আগে বলা ঠিক হবে না।’
বেবিচক চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘কিছু ক্লজ আছে। ওরা ওদের পয়েন্টে যুক্তি দেখাচ্ছে। আমরা আমাদের পয়েন্টে যুক্তি দেখাচ্ছি। এর ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার কতটুকু শেয়ার পাবে, তারা কত পাবে এটা নিয়ে দ্বিমত আছে। ওরা একটা পজিশন বলেছে। আমরা একটা পজিশন বলেছি। একদিন, দুইদিন পরপর মিটিং হচ্ছে। দেখা যাক, কত দ্রুত আমরা একটি চুক্তিতে পৌঁছতে পারি।’
বেবিচক ছাড়াও বাংলাদেশ সরকারের পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটি (পিপিপি কর্তৃপক্ষ) থার্ড টার্মিনালে অপারেটর নিয়োগের বিষয়টি দেখভাল করছে। সংস্থাটি টার্মিনালের পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি প্রকল্পও বাস্তবায়ন করছে। পিপিপি কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, চুক্তির জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল দেয়া হয়েছে। এ প্রস্তাবের আলোকে বর্তমানে অপারেটর নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
থার্ড টার্মিনাল নির্মাণে ঋণ দিয়েছে জাইকা। প্রকল্পটির পরামর্শক ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জাপানের। নির্মাণের পর টার্মিনালটি পরিচালনার জন্য যে ঠিকাদার নিয়োগ করা হচ্ছে তাও জাপানের। শুরু থেকেই এ অপারেটর নিয়োগ প্রক্রিয়াটি চলেছে শুধু একটি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গেই। এর পরিবর্তে নিয়োগ প্রক্রিয়াটি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতিতে হলে বাংলাদেশ কম খরচে বিশ্বমানের বিমানবন্দর পরিচালনা প্রতিষ্ঠানকে থার্ড টার্মিনালের দায়িত্ব দিতে পারত বলে মনে করছেন অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক।
এ প্রসঙ্গে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘থার্ড টার্মিনালের মতো উন্নত, আধুনিক অবকাঠামো পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিদেশী দক্ষ থার্ড পার্টি দরকার। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা একমাত্র জাপানি কনসোর্টিয়ামকে কেন চিন্তা করব? কেন কাজটি প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র প্রক্রিয়ায় নেব না? উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যৌক্তিক ও সাশ্রয়ী মূল্যে অপারেটর পাওয়া সম্ভব এবং তা নিয়ে কখনো প্রশ্নও উঠবে না। এখন শুধু একটা কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে কাজটি করলে তা কখনই প্রতিযোগিতামূলক ও সাশ্রয়ী হবে না। আমি শুনেছি, কাজটি করার জন্য জাপানি কোম্পানি প্রচুর টাকা দাবি করেছে।’