কাজী স্বাধীন, নাজমুল হুদা: হুমায়ূন আহমেদ এর শেষ লেখা ছিল ‘নবীজি’। কেন নবীজির সীরাতে নিয়ে উপন্যাস লিখা শুরু করেছিলেন। সে এক বিস্ময়কর ঘটনা।
সীরাত বিষয়ক রচনা ‘নবীজি’ লিখতে লিখতে ইহলোক ত্যাগ করেন। হুমায়ূন আহমেদ নবীজির জীবন লিখা শুরু করেই হঠাৎ লেখা বন্ধ করে দিলেন। এই খেয়ালে যে ‘যাকে নিয়ে লিখব, তাকে স্বপ্নে অনেকেই দেখেছেন। আমিও দেখতে চাই’।
এই ছেলেমানুষি আর জেদ নিয়ে সর্বশেষ হাজির হয়েছিলেন, নবীপ্রেমিক, সীরাত সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের কাছে।
নবীজি লেখার পেছনে মূল ঘটনা হল, প্রকাশনা সংস্থা অন্যপ্রকাশ যখন বাংলাবাজারের পূর্বতন বিক্রয়কেন্দ্র পরিবর্তন করে বৃহৎ পরিসরে বর্তমান বিক্রয়কেন্দ্র উদ্বোধনের জন্য হুমায়ূন আহমেদকে অনুরোধ করে, তিনি তাতে সম্মতি দেন। লেখালেখির শুরুর দিকে প্রকাশনাসংক্রান্ত কাজে প্রায়ই বাংলাবাজারে এলেও পরে দীর্ঘদিন আর ওমুখো হননি তিনি। অন্যপ্রকাশের নতুন বিক্রয়কেন্দ্র উদ্বোধন উপলক্ষে বহুদিন পর তিনি বাংলাবাজারে এলেন।যথাসময়ে ফিতা কেটে উদ্বোধন করা হলো বিক্রয়কেন্দ্র। একজন মাওলানা সাহেব হৃদয়াগ্রহী দোয়া করলেন।
তারপর কী ঘটল সেটা হুমায়ূন আহমেদ নিজেই বিভিন্ন পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেছেন। সর্বশেষ দৈনিক কালের কন্ঠে’র সাময়িকী ‘শিলালিপি’তে [২১ অক্টোবর, ২০১১] হুমায়ূন আহমেদের নিজের ভাষায়,
‘আমি খুবই অবাক হয়ে তাঁর প্রার্থনা শুনলাম। আমার কাছে মনে হলো, এটি বইপত্র সম্পর্কিত খুবই ভালো ও ভাবুক ধরণের প্রার্থনা। একজন মাওলানা এত সুন্দর করে প্রার্থনা করতে পারেন যে আমি একটা ধাক্কার মত খেলাম। মাওলানা সাহেবকে ডেকে বললাম, ‘ভাই, আপনার প্রার্থনাটা শুনে আমার ভালো লেগেছে।’ মাওলানা সাহেব বললেন, আমার জীবনের একটা বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল আপনার সঙ্গে একদিন দেখা হবে। আল্লাহ আমাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছেন। আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে।‘
আমি তাঁর কথা শুনে বিস্মিত হলাম।
আমি বললাম, ‘এই আকাঙ্ক্ষাটি ছিল কেন? মাওলানা সাহেব বললেন, ‘আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই, কারণ আমি ঠিক করেছি, দেখা হলেই আপনাকে একটা অনুরোধ করব।‘‘কী অনুরোধ শুনি?’
‘আপনার লেখা এতলোক আগ্রহ নিয়ে পড়ে, আপনি যদি আমাদের নবী-করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনীটা লিখতেন, তাহলে বহু লোক লেখাটি আগ্রহ নিয়ে পাঠ করত। আপনি খুব সুন্দর করে তাঁর জীবনী লিখতে পারতেন।‘
মাওলানা সাহেব কথাগুলো এত সুন্দর করে বললেন যে, আমার মাথার ভেতরে একটা ঘোর তৈরি হলো। আমি তাঁর কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘ভাই, আপনার কথাটা আমার খুবই মনে লেগেছে। আমি নবী-করিমের জীবনী লিখব।‘
চট করে তো জীবনী লেখা যায় না। এটা একটা জটিল ব্যাপার, কাজটা বড় সেনসেটিভ। এতে কোথাও একটু উনিশ-বিশ হতে দেওয়া যাবে না। লিখতে গিয়ে কোথাও যদি আমি ভুল তথ্য দিয়ে দিই, এটি হবে বড় অপরাধ। আমি নবীজির সীরাত পড়তে শুরু করি। মদীনা পাবলিকেশন্স থেকে খান সাহেব হুজুরের লিখা সব সীরাত গ্রন্থ সংগ্রহ করলাম। তাঁর পরামর্শ নিয়ে কাজ শুরু করি। আমার জানামতে এদেশে নবীজির জীবনী মুহিউদ্দীন খানই সবচেয়ে ভালো জানেন। এনিয়ে তিনি ব্যাপক কাজ করেছেন।
আমি অন্যদিন-এর মাসুমকে বললাম, ‘তুমি একটা সুন্দর কাভার তৈরি করে দাও তো। কাভারটা চোখের সামনে থাকুক। তাহলে আমার শুরু করার আগ্রহটা বাড়বে।‘ মাসুম খুব চমৎকার একটা কাভার তৈরি করে দিল।বইটার নামও দিলাম ‘নবীজি’।
অল্প কয়েক লাইন লেখার পরেই একটা ছেলেমানুষি ঢুকে গেল মাথার মধ্যে। ছেলেমানুষিটা হলো, আমি শুনেছি বহু লোক নাকি আমাদের নবীজিকে স্বপ্নে দেখেছেন। কিন্তু আমি তো কখনো তাকে দেখি নি। আমি ঠিক করলাম, যেদিন নবীজিকে স্বপ্নে দেখব, তার পরদিন থেকে লেখাটা শুরু করব। স্বপ্নে এখন পর্যন্ত তাকে দেখি নি। যেহেতু এক ধরণের ছেলেমানুষি প্রতিজ্ঞার ভেতর আছি, সে কারণে লেখাটা শুরু করতে পারি নি। ব্যাপারটা হাস্যকর। তবু আমি স্বপ্নের অপেক্ষায় আছি।
অতঃপর নবীজিকে দেখার প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুহিউদ্দীন খানের কাছে ফের হাজির হন। খান সাহেব তাঁকে নিজের লেখা জনপ্রিয় গ্রন্থ ‘স্বপ্নযোগে রাসূল সা.’ পড়তে দিলেন। হুমায়ূন বইটি হাতে নিয়ে আবেগী হয়ে উঠেন। বাসায় এসে বারবার পড়তে থাকেন। এই মুহূর্তে তাঁর শরীরে ধরা পড়ে মরণব্যাধি ক্যান্সার। তিনি চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় চলে যান।
যাবার আগের রাতে তিনি শাওনকে বললেন, ‘আমার জায়নামাজ, তাসবিহ আর মুহিউদ্দীন খানের ‘স্বপ্নযোগে রাসূল সা.’ গ্রন্থটি লেদারে ভরে রেখ।‘ আমেরিকায় গিয়ে এই একটি মাত্র গ্রন্থ তাঁর প্রিয় সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। মুহিউদ্দীন খানের সীরাত চর্চা, সীরাতপ্রেম জীবন সায়াহ্নে এসে তাঁর প্রিয় হয়ে উঠেছিল।
নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এসময় নিউইয়র্কে চিকিৎসা করাতে এসে নিয়মিত নামাজ পড়তেন। জামাল আবেদীন হুমায়ূন আহমেদকে নামাজ পড়া দেখে একটি নতুন জায়নামাজ এবং তসবিহ উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর কাছ থেকে তিনি নানান দোয়া দরুদ শিখে নিয়েছিলেন তখন। অধিকাংশ সময় নামাজ শেষে জায়নামাজে ধ্যান করে একাকী দীর্ঘ সময় বসে থাকতেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীনাবস্থায় হুমায়ূন নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। একদিন বললেন, ‘আমি একটি জিনিসের অপেক্ষায় আছি।‘ সেই ইচ্ছেটা পূরণ হলে লিখতে বসব। তুমি আমার জন্য কাগজ কলম এনে রেখ। জীবনের শেষ লেখাটা শুরু করতে হবে হয়তো।‘ এ কথা মৃত্যুর পর বিভিন্ন মিডিয়াকে জানিয়েছিলেন জামাল আবেদীন।
নিজের উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মতোই রহস্য রেখে গেলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক, নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ। মৃত্যুর আগে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, কালজয়ী বাংলা সাহিত্য রচনা করতে চান তিনি। শেষ একটা লেখা তার মাথায় আছে। সেটা লিখে তিনি মরতে চান। বলেছিলেন- কি লিখবেন তা তাঁর মাথায় আছে। কিন্তু তিনি বলবেন না। সেটা লিখার জন্য অনেক বেশি সাধনা আর চর্চা করতে হয়।
মৃত্যুর কয়েকমাস আগে তার ওই সাক্ষাৎকারটি নেন বিবিসি’র অর্চি অতন্দ্রিলা।
আমরা সাক্ষাৎকারটি এখানে তুলে ধরছি।
বিবিসি: তো আপনি শেষ পর্যন্ত লেখালেখি চালিয়ে যেতে চান?
হুমায়ূন আহমেদ: আমি পারবো কিনা জানি না। আমার গোপন ইচ্ছা এবং প্রগাঢ় ইচ্ছা হচ্ছে- মৃত্যুর এক-দু’ঘন্টা আগেও বাংলাগদ্য লিখতে পারি, যেন হা-হুতাশ করে না মরি। আল্লাহকে স্মরণ করে মরতে পারি। আমি সেই গদ্যটি লিখার জন্য অনেক সাধনা ও স্ট্যাডি করছি।‘
নিঃসন্দেহে হুমায়ূন আহমেদের সেই শেষ বাংলা গদ্যটি ছিল ‘নবীজি’। আমার কাছে মনে হয় তিনি হয়তো ভাবতেন, ‘নবীজি’ লেখার মতো যোগ্যতা তাঁর নেই। কিন্তু তিনি এক মাওলানা আর তাঁর পিতাতুল্য মুহিউদ্দীন খানের কাছে ওয়াদা করেছিলেন ‘নবীজি’ লেখার। রহস্যপুরুষ হুমায়ূন শেষ পর্যন্ত একটি গভীর প্রেমের রহস্যে ডুব দিয়েছিলেন। তা হলো নবীজি স্বপ্নে দেখার প্রবল ইচ্ছে জেগেছিল তাঁর ভেতরে। মৃত্যুর আগে যতোটা না ‘নবীজি’ শেষ করার ইচ্ছে ছিল, তার চেয়েও বেশি ইচ্ছে ছিল নবীজি লিখতে লিখতে যেন তাঁর মৃত্যু হয়। মনে হয় তাঁর সেই ইচ্ছে পুরো করেছিলেন মহান প্রভু।
একরাতে হুমায়ূন আহমেদ ঘুম থেকে উঠে অযু করে নামাজ পড়লেন। তারপর গোসল করে লিখতে বসলেন। সে রাতে কি ঘটেছিল, কি লিখেছিলেন সেটা লিখেছেন তার স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন।
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর তাঁর অপ্রকাশিত কিছু রচনা নিয়ে ‘লীলাবতীর মৃত্যু’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সেই গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন তার স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন। ভূমিকাতে হুমায়ূন আহমেদের শেষ কাজ হিসাবে গ্রন্থটির প্রধান আকর্ষণ উল্লেখ করেছেন নবীজিকে। তিনি সেখানে নবীজি লিখার ঘটনা প্রবাহ চিত্রায়িত করেছেন।
এছাড়া গ্রন্থটি প্রকাশের পর তিনি মিডিয়াকে বলেছেন। হুমায়ূন আহমেদ ‘নবীজি’ কিছু লেখার পর নবীজিকে স্বপ্নে দেখার ইচ্ছায় লেখাটি বন্ধ করে দেন। আমেরিকাতে চিকিৎসাধীন এক রাতে ঘুম থেকে উঠে গোসল করে ‘নবীজি’ লেখা ফের শুরু করেন। এটি লিখাবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। এটাই হুমায়ূন সাহিত্যের শেষ কাজ। হুমায়ূন নবীজিকে সে রাতে সম্ভবত স্বপ্নযোগে দেখেছিলেন। না হয় নবীজি ফের শুরু করার কথা নয়। কিন্তু রহস্যমানব নবীজিকে দেখেছেন কি না এটা কাউকে বলে যান নি।
সূত্রঃ ত্রৈমাসিক হেরার জ্যোতি, ৪র্থ বর্ষ, ৭ম সংখ্যা, জানুয়ারী, ২০১৭। মাওলানা মহিউদ্দীন খান রহ. এর স্মরণে বিশেষ সংখ্যা।
* কাজী স্বাধীন এর পোষ্ট থেকে কপিকৃত।