মনজুরুল হক
ক্রিকেট মাঠে প্রতিপক্ষের অর্জনকে অভিনন্দিত করা, উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানানো ক্রিকেট সৌজন্য। লর্ডস বা ওভালে ভারত, পাকিস্তান, উইন্ডিজের ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরিকে ব্রিটিশ দর্শকরা হ্যাটস অফ জানায়। ঠিক তার উল্টোটা ঘটে বাংলাদেশের ক্রিকেট মাঠে। এখানে প্রতিপক্ষ মানেই যেন চিরশত্রæ! ব্যতিক্রম কেবল পাকিস্তান। এই দেশটির সঙ্গে খেলা হলে সিংহভাগ বাঙালির জয়-পরাজয় ধর্মীয় রাজনীতির বার্গারে স্যান্ডউইচ হয়ে থাকে। কেন এমন হয়? কারণ কী? ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনের পর হেফাজতে ইসলামের কাউন্টার রিভেঞ্জ হিসেবে শাপলা চত্বর দখলের পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতি মোটাদাগে ভাগ হয়ে গেছে। ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের দল একটানা থাকার পরও দুই ভাগের বড় ভাগ দক্ষিণপন্থি তথা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর হাতে। কার্যত ক্ষমতাসীন দলটিই এখন তাদের আশ্রয়স্থল।
শাপলা চত্বরে পরাজয়ের পরও হেফাজত কার্যত পরাজিত হয়নি। তারা কৌশল বদলে ‘নারী নেতৃত্ব হারাম’ ফতোয়াকে বগলের তলে লুকিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে, বিশেষ করে দলনেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আপোস করে তাঁকে ‘কওমি জননী’ খেতাব দিয়ে সাফ-সুতোর হয়ে যাওয়ার পর থেকে ১৩ দফার আলোকে একে একে পাঠ্যপুস্তক ধর্মীয়করণ হয়েছে, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধর্মীয় আচার-আচরণ মহামারির মতো ছড়িয়েছে, অফিস-আদালতে ধর্মীয় জজবা চালু হয়েছে, নারীরা বোরকাবন্দী হয়েছে, দিকে দিকে ওয়াজিরা মুক্তমনা, বামমনস্ক, প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিষোদগার করেছে, গ্রামে গ্রামে বাউলগান, যাত্রাপালা, পালাগান, কবিগান নিষিদ্ধ হয়েছে, ব্যাংক, বীমা, অফিস, দফতরে ধর্ম চেতনার জোয়ার এসেছে, বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে কুৎসিত কদাকার অশ্রাব্য ওয়াজ ‘বাধ্যতামূলক’ হয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো সাংস্কৃতিক কর্মকাÐ সীমিত হয়েছে। অর্থাৎ গোটা সমাজ তথা দেশে এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গলাবাজি ছাড়া আর সকল ক্ষেত্রে মৌলবাদ জেঁকে বসেছে। বিস্ময়কর হলো বাংলাদেশের সমাজে যেভাবে ‘অলিখিত ইসলামী আইনের শাসন’ চলছে তা বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়াতেও নেই।
এসবেরই ব্যাকফায়ার আজকের নতুন পাকিস্তানপন্থি প্রজন্ম।
যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি তো বটেই, তা বিশ্বাসও করে না! তারা বাইডিফল্ট প্রচÐ রকম ভারত বিদ্বেষীর তকমায় হিন্দু বিদ্বেষী। ফারাক্কার পানি, তিস্তার মরুকরণ, সীমান্তে বিএসএফের হত্যা, অসম বাণিজ্য, কম শুল্কে করিডোর, পেঁয়াজ-গরু বাণিজ্য নিয়ে যতোটা যুদ্ধংদেহী তার বিপরীতে একাত্তরে পাকিস্তানের নির্মমতম মানবতাবিরোধী অপরাধ, নারী ধর্ষণ, যুদ্ধাপরাধ নিয়ে ততোটাই নৈর্ব্যক্তিক, যেন মুক্তিযুদ্ধটা কেবলই ইতিহাসের পাঠ্য! পাকিস্তানপন্থাকে সুবিধামতো ‘খেলার সঙ্গে রাজনীতি মেশাবেন না’, ‘তাদের খেলা ভালো লাগে’, ‘খেলাকে খেলার মতো দেখুন’-এর মতো খোঁড়া যুক্তি দিয়ে তারা তাদের তীব্র পাকিপ্রেম জায়েজ করে নিয়েছে এবং সরকার আর সরকারের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনসহ বিসিবি হাসিমুখে সেসব আশকারা দিয়েছে। আজকে এই এক পতাকা ইস্যু দিয়ে তারা নিপীড়ন-নির্যাতন, দারিদ্র্য, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, চুরি-ডাকাতি সব জায়েজ করে নিতে পেরেছে। বিসিবি তাদের অযোগ্যতা, ‘মাফিয়াতন্ত্র’, দলবাজি হালাল করতে পেরেছে। তাই গ্যালারিতে পাকিস্তানের পতাকামাতম কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে ভাবার কারণ নেই। সবই রাজনীতি। দক্ষিণপন্থায় টাল খাওয়া এই রাজনীতি অচিরেই মৌলবাদে পরিণত হতে যাচ্ছে। ক্রিকেট এখানে উপলক্ষ মাত্র। কেবলই কর্পোরেট বিজনেস টুলস। Monjurul hqর ফেসবুক ওয়ালে লেখাটি পড়ুন।
আপনার মতামত লিখুন :