শিরোনাম
◈ পশ্চিম তীরে দখলদার ইসরায়েলিদের সাথে তাদেরই সেনা জড়ালো সংঘর্ষে! (ভিডিও) ◈ আমদানি-রপ্তানিতে এনবিআরের নতুন নিয়ম: বাধ্যতামূলক অনলাইন সিএলপি দাখিল ◈ জুলাই স্মরণে শহীদ মিনারে ছাত্রদলের মোমবাতি প্রজ্বলন (ভিডিও) ◈ জুলাই বিদ্রোহ: কোটা সংস্কার থেকে গণঅভ্যুত্থান ◈ ভারতের বাংলাদেশ সফর নিয়ে যা বললেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল ◈ ৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ, ক্যাডার পদে মনোনয়ন পেলেন ১৬৯০ জন ◈ ১৮ জুলাই নতুন দিবস ঘোষণা ◈ ডিসি-এসপি কমিটি ও ইভিএম বাদ, ভোটকেন্দ্র স্থাপনে নতুন নীতিমালা জারি করলো ইসি ◈ বাংলাদেশে আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স: কীভাবে পাবেন, কী কী শর্ত মানতে হবে? ◈ এবার থাইল্যান্ড থেকে ভারতগামী বিমানে ১৬ টি সাপ, এরপর যা ঘটল

প্রকাশিত : ১৭ নভেম্বর, ২০২১, ০১:৩৮ রাত
আপডেট : ১৭ নভেম্বর, ২০২১, ০১:৩৮ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

মোজাফ্ফর হোসেন: কতোশত প্রশ্ন করতাম, স্যার বিরক্ত না হয়ে সহাস্যে উত্তর দিয়ে যেতেন

মোজাফ্ফর হোসেন: হাসান আজিজুল হক স্যারকে শেষবার যখন চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনা হলো তখন তাঁর ছেলে ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি, বাঁচার জন্য আব্বার ভাত-তরকারির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সঙ্গ, হাসি, গল্প, গান দরকার হয়। সংগত কারণেই এ সময় (করোনাকালে) সেটা পাচ্ছেন না।’ সত্যিই, স্যার একা থাকার মানুষ ছিলেন না। রাজশাহীতে ছয়-সাত বছর থাকার সূত্রে দেখেছি, দেখে মনে হয়েছে, ‘লেখক-শিল্পীরা নির্জন থাকতে পছন্দ করেন’, কথাটা স্যারের জন্য মিথ। যখন স্যারের বাসায় যেতাম ফেরার কথা ভুলে যেতাম। ঢাকায় আসার পর যোগাযোগটা হতো ফোনেই। স্যার কল করে শুরুতেই বলতেন, ‘হ্যাগো স্বকৃত কেমন আছো? হামীম, পিয়াস ভালো আছে তো? ঝর্নাকে বলো তো কল করতে। জানু-আপার ওখানে গিয়েছিলে? চন্দনের (লেখক অধ্যাপক চন্দন আনোয়ার) সঙ্গে তোমার কথা হয়? এভাবে একে একে অনেকের খোঁজ নিতেন। তারপর বলতেন, ‘কী লিখছ এখন?’ শুরু হতো সাহিত্যের কথা। মাঝে একটা বছর শুধু হেমিংওয়েকে নিয়ে কথা হয়েছে। তখন তিনি হেমিংওয়ের গল্প অনুবাদ করছিলেন। আমি হেমিংওয়ের গল্পসমগ্র পাঠিয়েছিলাম, ইন্ডিয়ান ক্যাম্প গল্পটি খুঁজে পাচ্ছিলেন না বলে। নতুন লেখকদের পড়ার ব্যাপারেও ভীষণ আগ্রহ ছিলো। একদিন বললেন, কী পড়ছো? আমি বললাম, মার্গারেট অ্যাটউড। বললেন, নাম শুনেছি, ভালো লাগলে পাঠাওতো, পড়ে দেখি। আমি স্যারকে ঞযব ঐধহফসধরফ'ং ঞধষব পাঠালাম।

স্যারকে কতোশত প্রশ্ন করতাম, স্যার বিরক্ত না হয়ে সহাস্যে উত্তর দিয়ে যেতেন। মাঝে মধ্যে দুষ্টুমিও করতাম, একদিন বললাম, ‘স্যার, আপনার আত্মজীবনীর সিরিজে কোথাও বাল্যপ্রেমের কথা নেই।’ এরপর হাসতে হাসতে বললেন, অপেক্ষা করো কিশোরকালের পরবর্তী অংশে পাবে। তারপর একদিন সহাস্যে বললেন, এ কারণেই তরুণ বয়স নিয়ে লিখবো না, বুঝেছো? একদিন একটা নতুন গল্প সম্পর্কে কথা বললেন রায় কুড়িয়ে বেল গ্রন্থে সেটা আছে। কিশোরীর শরীরের বর্ণনাংশটা নিয়ে আমার আর নোমান ভাইয়ের সঙ্গে দুষ্টুমি করলেন। ঢাকায় আসলে সাধারণত জানু আপার বাসায় অথবা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে উঠতেন, আমরা রাতে স্যারের কক্ষে যেতাম এবং উঠে আসা মুশকিল হতো। গত চৌদ্দ-পনেরো বছরে বইয়ের চেয়ে মনে হয় যেন স্যারের কথা থেকে বেশি জেনেছি, শিখেছি। একসময় মনে হয় শিক্ষক, একসময় বন্ধু, একসময় অভিভাবক। আমি সবসময় বলি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ এই কারণে না যে আমাকে সার্টিফিকেট দিয়েছে, আমাকে হাসান আজিজুল হক দিয়েছে এই কারণে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রথম সপ্তাহে স্যারকে পেয়ে যাই কলাভবনের একটি কক্ষে। স্যার দর্শনের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইংরেজি বিভাগের একটা অনুষ্ঠানে এসেছেন। সম্ভবত জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী স্যারও ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। সকলে ইংরেজিতে বক্তৃতা করছিলেন। স্যার প্রধান অতিথি বা সভাপতি। স্যার কথা বলতে উঠে প্রথমেই বললেন, ‘আমি চেষ্টা করলে ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারবো। কিন্তু আমি বাংলাতেই কথা বলছি। আশা করি আপনাদের বুঝতে অসুবিধা হবে না।’ সেই প্রথম হাসান আজিজুল হককে দেখলাম। তাঁর কথা শুনলাম। কয়েকমাস পরে গেলাম স্যারের কাছে, সঙ্গে বন্ধু রাতুল ও হিশাম। আমাদের শাশ্বতিকী পত্রিকার জন্য লেখা নিতে। ‘বাংলা গদ্যে দর্শনচর্চার সমস্যা’ এই প্রবন্ধটা আমরা রিপ্রিন্ট করতে চাই। স্যার শুরুতেই আমাদের নাম ও জেলা জেনে নিলেন। প্রায় ছ’মাস পর যখন স্যারকে পত্রিকা দিতে গেলাম। স্যার প্রথমেই দাঁড় করিয়ে আমাদের তিনজনের নাম ও কোন জেলা থেকে এসেছি বলে দিলেন। আমরা স্যারের স্মৃতিশক্তি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। সেই শুরু। স্যার আমার আদিম বুদবুদ গল্পগ্রন্থের ফ্লাপও লিখে দিলেন।

গত এক বছর ধরে আর স্যারের সঙ্গে কথা হতো না। তিনি অসুস্থ থাকার আগে থেকেই কানে ঠিকমতো শুনতে পেতেন না, বিস্ময়কর স্মৃতিশক্তি যার, সেই মানুষ কথা বলতে বলতে দু’মিনিট আগে কী বলেছেন সেটাই ভুলে যেতেন, একই বিষয়ে কয়েকবার কথা বলতেন, তখন বুকটা কেঁপে উঠতো। শেষ কথা হয়েছে স্যারের কবিতার বইটি নিয়ে। করোনা আসার পর সবসময় বলতেন, করোনা গেলে তুমি আর স্বকৃত রাজশাহীতে আসো। পিয়াসকেও বলো। আমি আর নোমান ভাই কয়েকবার পরিকল্পনাও করলাম। আমরা ঠিক করেছিলাম সারারাত স্যারের সঙ্গে দুষ্টুমি করবো। সবটা রেকর্ড করে রাখবো নিজেদের জন্য। একবার তো যাত্রার দিনক্ষণও ঠিক করে ফেলেছিলাম। কিন্তু আর হলো না। স্যারের সঙ্গে শেষদিকে আর কথা না হলেও তবু জানতাম তিনি আছেন, মনে হতো, এই সুস্থ হবেন, আমরাও যাবো। কিংবা স্যারই সুস্থ হয়ে ঢাকায় আসবেন। না, আর তিনি আসবেন না। রাজশাহীতে ঠিকই যাবো, কিন্তু বিহাসের সেই বাড়িতে আমাদের জন্য কেউ আর অপেক্ষা করবে না। বিহাসের উজান নামের বাড়িটাও যেন মুহূর্তেই দূরে সরে গেলো। স্যার, বিহাসের ওই বাড়িতে আর কোনোদিনই যাবো না। এতে মনের কোথাও ঠিকই মনে হবে আপনি আছেন। সশরীরেই আছেন। আপনি বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান লেখক, আপনার সৃষ্টি তো অমর, আপনি ব্যক্তি হিসেবেও আমার কাছে অমর আমার স্মৃতিতে, আমার ভালোবাসায় এবং আমার শ্রদ্ধায়। আপনাকে তাই বিদায় বলতে পারছি না।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়