ফিরোজ আহমেদ: ‘অপ্রকাশের ভার’ ছিলো হাসান আজিজুল হকের কেনা আমার প্রথম বই, প্রথম পড়া বই সম্ভবত ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ কিংবা ‘পাতালে হাসপাতাল’। প্রথমটা কিনেছিলাম পাবলিক লাইব্রেরিতে ইউপিএল-এর কোনো একটা গ্রান্ড সেল থেকে, দ্বিতীয়টা কিনেছিলাম চারুকলার ফুটপাথে, তৃতীয়টা বাসাতে কোনোভাবে এসেছিলো, সম্ভবত আমার ভাইয়ের মাধ্যমে। এসব সেই পুরনো যুগের কথা, সময় সেখানে লেপ্টে গেছে। তাই কোন গল্পটা দিয়ে তাকে প্রথম চিনেছিলাম, সেটা আর মনে করতে পারছি না। শুধু বলতে পারি তার কোনো লেখা সামনে পড়েছে এবং পড়িনি, এমনটা তখনকার দিনে হওয়ার উপায় ছিলো না। অপ্রকাশের ভার শব্দবন্ধটা মাথায় আশ্রয় করেছে তারপর বহু যুগ। ভাষাকে কেউ কেউ আবিষ্কার করেন। তারা প্রণম্য, তাদের আর সব দৈনন্দিন মতাদর্শের ঊর্ধ্বে। হাসান আজিজুল হক সম্পর্কে বহু কথা বলা যেতো। তার চিন্তা, তার স্বকীয়তা, তার অসম্ভব আড্ডার সব স্মৃতি- এখন মনে হচ্ছে তার অনায়াসে বলা গল্পগুলো যদি কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ধারণ করে রাখতো, অসম্ভব এক বাচনশিল্পের উদাহরণ হয়ে থাকতো, এমনই রসিক, আড্ডাবাজ আর বন্ধুঅন্তঃপ্রাণ মানুষ ছিলেন তিনি। তার রাজশাহীর বাসায় মুরাদের সঙ্গে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বাসায় আরিফ-নীলার সঙ্গে বহুবার অফুরন্ত গল্প শুনেছি, সাকি ভাই, আনু ভাইদের উপস্থিতিতে সেগুলো যেন তারার মেলা হয়ে থাকতো।
কিন্তু তবু যে মানুষ অত বেশি প্রকাশ করে, তারও বহুগুণ অপ্রকাশিত থাকে। হাসান আজিজুল হকরা ৯০ এর ঘা খাওয়া মানুষ। যে স্বপ্নসৌধ তারা জীবনভর নির্মাণ করে এসেছিলেন, জনমানসে তার রাতারাতি বিলুপ্তি বহুজনের ওপর বহুভাবে ভূমিকা রেখেছে। কেউ রাতারাতি, কেউ ধীরে নিজেদের অতীতটাকে নানা অর্থেই পর্যালোচনা করেছেন, বর্তমান সম্পর্কে ভাবনা বদলেছেন। কিন্তু মনে হয় একটা ঘোরতর আঘাত আর ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতাকে তাদের সকলকেই নিজের ভেতরে সামলাতে হয়েছে, বাইরের দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করার চাইতে কতো বিপর্যয়কর ছিলো না সেটা। বিদায়, হাসান আজিজুল হক। বাংলা ভাষাকে আপনার মতো করে আপনি আবিষ্কার করেছিলেন, এই ভাষা আপনাকে মনে রাখবে। হাস্যরসের আড়ালে আপনি আরও যা কিছু অপ্রকাশিত রেখে গেলেন, সেই ভার যারা আছেন তারা বহন করবেন। ফেসবুক থেকে