মঞ্জুরে খোদা টরিক : উটপাখি নিজের না দেখাকে অন্যেরও না দেখা মনে করে! আমাদের শাসকদের অবস্থা তেমনি। তাদের বুঝকেই অন্যেরও বুঝ মনে করে। নিজের জ্ঞানের স্তরকেই অন্যের জ্ঞান মনে করে। সমস্যা- সে বোধেরও অধিক- তারা যেন অন্যদের মূর্খ-অজ্ঞ ভাবার অধিকার অর্জন করেছেন। কেন বলছি এমন কথা। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, ‘রাত পোহালেই আয় বাড়ছে, আমরা অজান্তেই বড়লোক হয়ে যাচ্ছি।’ কী মজা ও আনন্দের কথা। এ যেন এক রূপকথার দেশ। ঘুম যতো গভীর হয়, ঘোর যতো বাড়ে, আয়-উন্নতিও যায় ওপরে। ২০২০-২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ৫৫৪ ডলার হয়েছে। বছর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ আয় বাড়ছে। কী তামাশা। আসলে কি তাই? অর্থনীতির প্রাথমিক জ্ঞান যারা রাখেন- তারাও জানেন জিডিপির হিসাবেটা কী, কেমন? জিডিপি হচ্ছে গ্রস ডমেসটিক প্রডাক্ট। মানে একটা দেশের এক বছরের মোট অভ্যন্তরীণ আয়। আর জিএনআই গ্রস ন্যাশনাল প্রডাক্ট মানে এক বছরে একটি দেশের জাতীয় আয়। একটি হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরীণ আয়-উৎপাদন অন্যটি হচ্ছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আয়ের হিসাবে।
গত দুই বছর মানে ২০২০-২১ সালে হচ্ছে সারাবিশ্বের মন্দা ও দুর্যোগের সময়। এ সময় সব দেশই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা হয়নি, তারা অনেক লাভ করেছে। সেটা কীভাবে সম্ভব? একেই বলে দুর্যোগের অর্থনীতি। দুর্নীতির অর্থনীতি। সে বিতর্কে না যাই। একটা প্রশ্ন করি, বাংলাদেশে এ সময়ে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে না কমেছে? বাংলাদেশের প্রায় এক-দেড় কোটি মানুষ চাকরি হারিয়েছে। এর সঙ্গে পুরনো বেকারত্বতো আছেই। তাহলে দেশের আয় বাড়লো কীভাবে? কাদের আয় বাড়লো? জিডিপি মাথাপিছু আয়ের হিসাবটা খুবই সহজ ও সরল একটি অঙ্ক। এক বছরে যাদের ও যেসব ধনীদের আয় বেড়েছে সেটা প্রথমে যোগ করা হয়। তারপরে সেই যোগফলকে দেশের মানুষের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা হয়। ব্যাস বেরিয়ে গেলো মানুষের মাথাপিছু আয়। তার মানে বাস্তবে সবার সেই আয় হয়নি। কিন্তু দুর্বিনীত শাসকের ভাবটা এমন যে, এ আয় সবার পকেটে যাচ্ছে। কিন্তু তা নয়। তারপর এই আয়ের কিছু বিষয়ে গোপন করা হয়।
যেমন: [১] জিনিসপত্রের যে দাম বেড়েছে, আপনি একই অর্থ দিয়ে আগে যা কিনতে পারতেন এখন তা পারেন না, সেটা বলা/যোগ করা হয় না। [২] কোনো একটা জমি/বন নিয়ে যে শিল্প তৈরি করা হলো তার ক্ষতির হিসাবে সেখানে যুক্ত করা হয় না। পরিবেশের যে ক্ষতি হলো সেটা যোগ করা হয় হয় না। [৩] মুদ্রস্ফীতি ও টাকার অবমূল্যায়নের বাৎসরিক হারকে যুক্ত করা হয় না। [৪] আর সবচেয়ে বড় ফাঁকি- জিডিপি বৃদ্ধির এই অঙ্কের সঙ্গে বিদেশ থেকে শ্রমিক ও পেশাজীবীদের পাঠানো অর্থও যোগ করা হচ্ছে। সেটা হওয়ার কথা নয়। [৫] জিডিপি মাথাপিছু আয়ের ধারণা দিয়ে মানুষ ও দেশের উন্নয়নের সংজ্ঞা নির্ধারণের দিন অনেক আগেই বাতিল হয়ে গেছে। যদি না তা মানুষের আয় সমতা, ক্রয়ক্ষমতা তৈরি করে। এভাবেই শাসকরা শোনাচ্ছেন আপনি ঘুমিয়ে থাকলেও, কাজ না থাকলেও, না খেয়ে থাকলেও, চিকিৎসা না পেলেও, শিক্ষা না পেলেও, থাকার জায়গা না থাকলেও, মানুষ বিচার না পেলেও বাংলাদেশ উন্নতি হচ্ছে, আপনি বড়লোক হয়ে যাচ্ছেন। এই বুঝি এ-৮এ ঢুকে পড়লো দেশ। বড় বড় প্রকল্প করতে হবে, বড় বড় বিনিয়োগ হবে, বড়লোকের পকেটে অনেক টাকা যাবে, সেখান থেকে কিছু চুইয়ে গরিবের হাতে পড়বে। একেই বলে সুশাসন ও গণতন্ত্র ছাড়া গোলাকধাঁধার অর্থনীতি। লেখক ও গবেষক
আপনার মতামত লিখুন :